বছরজুড়ে ছাদ বাগানে ৫ ফুল

ফুলের সৌন্দর্যে প্রাণীকুল সর্বদা বিমোহিত হয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ফল ও শস্য চাষের পাশাপাশি ফুলের কদরও কম হয়নি। সেটা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার কথাই বলুন বা আধুনিক ইউরোপের কথা। আরেকটু এগিয়ে গেলে দেখবেন ২০ থেকে ২৫ হাজার বছর আগেই ফুল দিয়ে মৃতদেহ সাজিয়ে কবর দেবার রীতি প্রচলিত ছিলো মানব সমাজে। সৌন্দর্য বর্ধনসহ ফুল আপনার মানসিক প্রশান্তির সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শহুরে নাগরিক জীবনের হাজারো বিক্ষিপ্ততার ভেতর তাই আপনার এক চিলতে ছাদে বা বারান্দায় ফুলের চাষ করে পেতে পারেন কিছুটা প্রশান্তি। আমরা আপনার সাথে সৌন্দর্য-বর্ধক ও সহজে চাষ করা যায় এমন কিছু ফুল নিয়ে এ লেখা।

ছাদে ফুটুক অজস্র গোলাপ

প্রথমেই আসি গোলাপের কথায়। গোলাপ আমাদের পরিচিত ফুলগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। কাঁটাযুক্ত ডালের উপরিভাগে নান্দনিক ফুল ফোটে। গোলাপ গাছ উচ্চতায় ৭ মিটার পর্যন্ত হয়। জেনে আশ্চর্য হবেন যে গোলাপের রয়েছে ১৫০-এর অধিক প্রজাতি। এটি ইংল্যান্ডের জাতীয় ফুল। বাংলাদেশ ও ভারতে গোলাপের রয়েছে প্রচুর চাহিদা। আজকাল বাণিজ্যিক ভাবে গোলাপ চাষের বিষয়টি তাই বেশ সাড়া ফেলেছে। এটা তো গেলো গোলাপ চাষের অর্থনৈতিক বাস্তবতা।

গোলাপের হাজারো গুণাগুণ

এখন আসা যাক গোলাপের ভেষজ গুণাগুণের কথায়। গোলাপের পাপড়ি ত্বকের যত্নে অত্যন্ত কার্যকর। গোলাপের সুগন্ধ ত্বককে সতেজ রাখে। পাপড়িতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা ফ্রি র‌্যাডিকেলসের ক্ষতি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। এছাড়া বিভিন্ন দূষণ, জীবাণু ও ইরিটেশন থেকে ত্বককে রক্ষার কাজও করে গোলাপ। এক চা চামচ গোলাপের পাপড়ি বাটা বা গুঁড়ার সাথে পরিমাণ মতো পানি মিশিয়ে ত্বকে লাগালে বেশ সজীব থাকবে আপনার ত্বক। আপনি চাইলে পানির বদলে মধুও ব্যবহার করতে পারেন। মেছতা সারাতেও গোলাপ খুবই চমৎকারভাবে কাজ করে। গোলাপের পাপড়িতে রয়েছে ভিটামিন-সি, যা মেছতা সারাতে ভূমিকা রাখে। গোলাপজলে কটনবল ডুবিয়ে আক্রান্ত জায়গায় ব্যবহার করলে মেছতা সেরে যায়। 

গোলাপ চাষের প্রক্রিয়া ও পরিচর্যা

গোলাপের চাষ প্রক্রিয়া তেমন জটিল বা শ্রমসাধ্য কোনোকিছু নয়৷ ছাদে গোলাপ চাষ করতে চাইলে প্রথমেই আপনাকে টব নির্বাচন করতে হবে। গোলাপ গাছের জন্য সাধারণত ১০-১২ ইঞ্চি টব নেবেন। এতে শিকড়ের বৃদ্ধি ভালো হবে। টবের নিচে বেশ কয়েকটি ছিদ্র রাখতে হবে। মাটি ভরাটের আগে ইটের টুকরো অথবা টবের ভাঙা অংশ দিয়ে ছিদ্রগুলো অবশ্যই ঢেকে দিতে হবে। 

গোলাপের জন্য আদর্শ মাটি হলো দোআঁশ। জৈব সার দিয়ে মাটি তৈরি করা ভালো তবে অল্প পরিমাণে রাসায়নিক সার দিলে গাছ দ্রুত বেড়ে উঠবে। ৫০% দোআঁশ মাটির সাথে বেলে মাটি ১০%, শুকনা গোবর সার ২০%, ভার্মি কম্পোস্ট ২০% মিশিয়ে নিবেন। মাটি তৈরির সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন অতিরিক্ত পানি মাটিতে অবস্থান না করে। মাটিতে হাফ চা চামচ ফসফেট, হাফ চা চামচ পটাশ, এক চা চামচ সরিষার খৈল, কোয়ার্টার চা চামচ ডিএপি, কোয়ার্টার চা চামচ এনপিকে দিয়ে মাটি তৈরি করবেন। এবার আপনার পছন্দের জাতের গোলাপের চারাটি  টবের মাটিতে রোপণ করতে পারেন।

রোপণের পর চারাটি শতভাগ পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে। চারা ছোট থাকা অবস্থায় এতে প্রতিদিন পানি দেবেন। গোলাপ গাছ নিয়মিত ছাঁটলে ঝোপাকৃতির হয় ও নতুন শাখা গজায়। গাছের আকার বড় হলে ৭-১০ দিন পরপর পানি দেবেন৷ এছাড়া আর তেমন কোনো ঝক্কি পোহাতে হবে না আপনাকে। দিনশেষে গোলাপ গাছটির সাথে হয়তো আপনার গড়ে উঠবে বন্ধুত্ব। 

রাঙা জবার রাঙা হাসি

জবা আমাদের দেশে অত্যন্ত সুপরিচিত ফুল। এটি সারাবছরই ফোটে। অনেকের কাছে জবা চায়না গোলাপ নামে পরিচিত৷ একটি পূর্ণবয়স্ক জবা গাছ উচ্চতায় ৮-১৬ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। সাধারণত হলুদ, সাদা, কমলা ও লাল রঙের জবা হয়ে থাকে। জবা ফুলে পাঁচটি পাপড়ি থাকে। এর মাঝে লম্বা শির থাকে। 

জবারও আছে বহু গুণ

চুল পড়া ও রুক্ষতা দূর করতে জবা কার্যকরী ভূমিকা রাখে। আমলকীসহ জবা ফুল ও পাতার পেস্ট এক অসাধারণ হেয়ার প্যাক। চুল, ত্বক ছাড়াও জবা পাতার চা আপনার খুব উপকারে আসবে। উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা দূর করতে, শরীরে কলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে, সর্দি-কাশি সারাতে এবং মুখের ঘা থেকে মুক্তি দেবে আপনাকে মুক্তি দিতে পারে এই চা। এছাড়া অ্যানিমিয়া রোগীদের জন্যও জবা উপকারী। এর নিয়মিত সেবনে শরীরে রক্তের পরিমাণ বাড়ে। 

যেভাবে করবেন জবার পরিচর্যা 

জবা গাছের আকার অনুযায়ী সময় সাপেক্ষে টব পরিবর্তন করতে হবে। চারা ছোট থাকা অবস্থায় ৪-৬ ইঞ্চির টবেই এটি প্রতিপালন করতে পারবেন। এরপর আড়াই থেকে তিন ফুট উঁচু হলে গাছকে ১২ ইঞ্চির টবে প্রতিস্থাপন করতে হবে৷

জবা গাছের মাটি প্রস্তুতের জন্য ৩ ভাগ গার্ডেন সয়েল, ২ ভাগ নদীর সাদা বালি, ১ ভাগ পুরোনো পাতা পচা অথবা গোবর সার মিশিয়ে বাঁশের চালনি দিয়ে চেলে নিতে হবে। এতে মাটি আলগা ও ঝুরঝুরে হবে৷ এই ঝুরঝুরে মাটির সাথে ১০০ গ্রাম সরিষার খৈল ও ১০০ গ্রাম শিং কুচি ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে প্লাস্টিকের বস্তায় রেখে দিতে হবে। মাটিতে অবশ্যই কিছু পানি স্প্রে করে নেবেন। যাতে মাটির আর্দ্রতা ঠিক থাকে। মাটির তৈরির এ পদ্ধতি দুই মাস চলবে। ১৫ দিন পরপর মাটিকে প্লাস্টিকের বস্তা থেকে বের করে রোদে ঝুরঝুরে করে নেড়ে দিতে হবে। এবারে আবার কিছুটা পানি স্প্রে করে আবার বস্তায় পুরে রেখে দেবেন। এভাবে মাটি তৈরি করে জবা গাছ রোপণ করলে অসাধারণ ফলাফল পাওয়া যাবে। গাছের বৃদ্ধি যেমন ভালো হবে তেমনি ফুলও ফুটবে ভালো। 

বাগান বিলাসের বিলাসিতা

বাগানপ্রেমীদের কাছে বাগান বিলাস অত্যন্ত প্রিয় ফুল। এটি সারাবছর ফোটে। সবুজ পাতার মাঝে ছোট ছোট ফুল সত্যিই মনোরম।  গাছটির আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকায়। আমাদের দেশে বেশ কয়েক রঙের বাগান বিলাস দেখা যায়। এরা সাধারণত বেগুনি, লাল, কমলা, হলুদ, সাদা ইত্যাদি রঙের হয়ে থাকে। বাগান বিলাসকে অনেকেই কাগজের ফুল নামে ডাকে। 

যেভাবে বাগান বিলাসের যত্ন নেবেন

৮-১২ ইঞ্চির টব বাগান বিলাসের জন্য উপযুক্ত। প্রথমে টবের নিচে ৪-৫ টি ছিদ্র করে নিতে হবে। এবার টবের ভাঙা অংশ, বা প্লাস্টিকের নেট ব্যবহার করতে হবে, যাতে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যেতে পারে। বাগান বিলাসের পরিচর্যায় আপনাকে একটু অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এই গাছটি প্রচুর খাদ্য গ্রহণ করে ও অতিরিক্ত পানি একেবারেই সহ্য করতে পারে না৷ তাই এর ড্রেনেজ সিস্টেম সর্বদা উন্নত হওয়া চাই। ৪০% গার্ডেন সয়েল, ৩০% নদীর বালি, ২০% ভার্মি কম্পোস্ট ভালোভাবে মিশিয়ে তাতে পাতা পচা সার, হাড়ের গুড়া, ফসফেট, নিম কম্পোস্ট ১০% দিতে হবে। মাটি তৈরি হয়ে গেলে সাথে সাথেই গাছ বসিয়ে দেওয়া যাবে না। মাটিকে ৪-৫ দিন রোদে রাখতে হবে। এরপর গাছকে টবের মাটিতে প্রতিস্থাপন করবেন। নতুন গাছ প্রতিস্থাপন করলে অন্তত সাতদিন অবশ্যই চারাকে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখুন। 

অলকানন্দা

অলকানন্দা ফুলকে ইয়োলো বেলও বলা হয়।  সবুজ পাতার গাছে হলুদ ফুল ফোটে। এই ফুল সারাবছরই কমবেশি দেখা যায়। এর জন্ম ব্রাজিলে। সাধারণত রোদেলা জায়গায় এই ফুল বেশি ফুটে। আপনার ছাদে অতি সহজেই একটি অলকানন্দা গাছ লাগাতে পারেন। ইচ্ছে হলে  বারান্দার রেলিং অথবা দেয়ালেও সাজাতে পারেন অলকানন্দার বাহার। গাছটি উচ্চতায় ৩-১০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। এটি পত্রঝরা ও গুল্ম প্রজাতির গাছ। মজার বিষয় হলো ডালের কাটিং ও বীজ দিয়ে এর বংশবিস্তার করা যায়। 

অলকানন্দা বহুগুণে গুণান্বিত

ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় অলকানন্দার পাতা বেশ উপকারে আসে৷ এছাড়া ঘাড়ের পেশি শক্ত করা বা মূত্রনালীর চিকিৎসার কাজেও এর পাতা ব্যবহৃত হয়৷ 

অলকানন্দার দেখাশোনা 

গাছের আকার অনুযায়ী ৬-১২ ইঞ্চির টব ব্যবহার করতে হবে । তবে এর জন্য উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা রাখতে হবে। টবের তলায় ছিদ্র করে এর উপর নেট বা টবের ভাঙা অংশ দেবেন। তার উপর স্টোন চিপ ও মোটা বালির স্তর দিতে হবে। যাতে সহজেই অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যেতে পারে। 

১ ভাগ গার্ডেন সয়েল, ১ ভাগ নদীর বেলে মাটি, ১ ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট, আধা ভাগ ককোপিট ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর নির্বাচিত চারাটি রোপণ করতে পারেন। যেহেতু অলকানন্দা রোদ ভালোবাসে। তাই বেশি ফুল পেতে চাইলে গাছকে অবশ্যই রোদে রাখতে হবে। ১৫ দিন পরপর আধা চা চামচ এনপিকে ১ লিটার পানিতে রাতে ভিজিয়ে রেখে সেই পানি ১ কাপ পরিমাণ গাছের গোঁড়ায় প্রয়োগ করলে গাছের বৃদ্ধি খুব ভালো হয়ে থাকে। তাছাড়া ১ চা চামচ হাড় গুড়া, ১ চা চামচ শিং কুচি, ১ চা চামচ সরিষার খৈল প্রতিমাসে একবার প্রয়োগ করতে হবে। এর ফলে গাছে সঠিক মাত্রায় ফুল ফুটবে। 

নাগরিক জীবনে জল পদ্ম

লোটাস বা পদ্ম একটি বহুবর্ষজীবী জলজ গাছ। পদ্মফুল গোলাপি, নীল, সাদা কয়েক রঙের হতে পারে। সাধারণত বর্ষা ও শরৎকাল পদ্ম ফোটার সময়। এখন হয়তো ভাবছেন, ইট-পাথরের শহরে ছাদের ওপর জল পদ্ম কিভাবে লাগাবেন? এটা তেমন কিছু নয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক জল পদ্মের চাষ প্রণালী।  

শহরে যেভাবে জল পদ্ম ফোটাবেন  

পদ্ম গাছ লাগানোর জন্য কংক্রিটের চৌবাচ্চার মতো মিনি পুকুর আদর্শ স্থান। তবে এটা না থাকলেও সমস্যা নেই। বড় মাটি কিংবা সিমেন্টের পাত্রে পদ্ম লাগানো যায়। প্রথমে পদ্ম বীজ সংগ্রহ করে জার্মিনেট করতে হবে। ভালো বীজ পরীক্ষা করার কিছু পন্থা আছে। খেয়াল করবেন, পরিপক্ব বীজগুলো সাধারণত কালো বর্ণের হয়। এর একপাশে কাঁটার মতো অংশ থাকে যার ঠিক বিপরীতে কিছুটা অংশ ঘষে নিতে হবে। বড় মগে পরিষ্কার পানিতে ঘষা বীজগুলো দিতে হবে। পদ্ম বীজ পানিতে ডুবে যায়, যেগুলো পানিতে ডুববে না, বুঝবেন সেগুলোর অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নেই। ৩-৫ দিন পরে বীজের অঙ্কুরোদগম হয়। ১২-১৫ দিনে গাছ মাটিতে রোপণের উপযুক্ত হয়।

গার্ডেন সয়লের মাঝে ৩০% জৈবসার মিশিয়ে নিবেন। পরিমিত মাটি একটি ছোট পাত্রে ভরে পানিতে ভিজিয়ে নেবেন। এবার জার্মিনেট করা গাছগুলো মাটিতে শিকড়সহ রোপণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বীজ যাতে ভেঙে না যায়। ছোট পাত্রের উপরে একস্তর বালি দেওয়া ভালো। এবারে ছোট পাত্রকে পানি পূর্ণ ড্রাম, চৌবাচ্চায় রাখতে হবে। গাছগুলো বড় হওয়ার সাথে তাল রেখে পানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। পদ্ম গাছ রোদ ভালোবাসে তাই একে রোদে রাখার চেষ্টা করুন৷ এই গাছে তেমন কীটনাশক বা সার লাগে না। তবে চাইলে প্রতিমাসে একবার মাটিতে ট্যাবলেট সার বা আধা চা চামচ ডিএপি সার দিতে পারেন। প্রতি মাসে অন্তত একবার চৌবাচ্চার পানি পরিবর্তন করবেন। যাতে সেখানকার বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য বজায় থাকে। 

এভাবে আপনার ছাদে চাষ করতে পারেন বিভিন্ন রকমের ফুল। শহুরে ইট-পাথরের মাঝে প্রাণ সঞ্চার করতে পারে আপনার ছাদের ফুলগাছ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *