রান্নার কাজে বহু আগে থেকেই মানুষ বিভিন্ন রকমের উদ্ভিদ জাতীয় মসলার ব্যবহার করে আসছে। আজকাল নাগরিক জীবনে প্যাকেটজাত খাবারে আমরা এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, উপাদানগুলোর সাথে পূর্বে যেমন আবেগময় আবহ ছিলো এখন আর তা নেই৷ দেখা যাচ্ছে, বারান্দা বা ছাদে কয়েকটি মসলার গাছ থাকলে এটি যেমন আপনার সময়কে সঠিক খাতে ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে তেমনি এতে অর্থ সাশ্রয়ও হবে। বাজারের তুলনায় বাড়ির মসলার গুণগত মান অনেক উন্নত হয়। এদিক থেকে ভাবলে, আপনার বাসার একখণ্ড জায়গা ব্যবহার করতে পারেন মসলা উৎপাদনের মতো এমন চমৎকার কাজে। যা আপনাকে অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের পাশাপাশি দেবে অর্গানিক খাদ্য উপাদানের স্বাদ। এই লেখায় আমরা এমন কিছু মসলা জাতীয় উদ্ভিদ রোপণ পদ্ধতি ও পরিচর্যা প্রসঙ্গে জানব।
নিত্যসঙ্গী মরিচ
রান্নায় বহুল প্রচলিত একটি উপাদান হলো মরিচ। মরিচ চাষের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে বর্তমান আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা মরিচ চাষ করতো। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে রান্নার কাজে ও ভেষজ হিসেবে মরিচ ব্যবহার করা হয়।
মরিচের চারা রোপণের সহজ উপায়
মরিচ কমবেশি সারাবছরই জন্মে, তাই বছরের যেকোনো সময় মরিচের চারা লাগাতে পারেন। তবে মে-জুন ও শীতের শুরুতে অর্থাৎ অক্টোবর- নভেম্বর মাসে মরিচের চারা লাগালে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
মরিচ গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এর জন্য খুব বেশি জায়গার দরকার হয় না। মরিচের চারা রোপণের জন্য আপনি মাঝারি আকারের টব নির্বাচন করবেন। দোঁআশ মাটি মরিচ গাছের জন্য উত্তম। টবের মাটি প্রস্তুতের জন্য ৫০% দোআঁশ, ৫০% গোবর সার বা ভার্মি কম্পোস্ট মিশিয়ে ৬-৭ দিন রেখে দিন। তারপর এতে ১ চা চামচ পটাশ, ১ চা চামচ ইউরিয়া, ১ চামচ টিএসপি সার দিয়ে ৩-৪ দিন রেখে মরিচ গাছ রোপণ করা উত্তম।
আপনি চাইলে মরিচের বীজ থেকে বা সরাসরি নার্সারি থেকেও চারা সংগ্রহ করতে পারেন। বীজ থেকে চারা তৈরি খুবই সহজ। শুকনা মরিচ থেকে কিছু পুষ্ট বীজ নিয়ে ১ গ্লাস পানিতে পানিতে ৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। ভেজা বীজগুলো তুলে এবার ২০-২৫ মিনিট শুকিয়ে নিন। টবের উপরিভাগের মাটি নিড়ানি দিয়ে নির্বাচিত বীজগুলো ছড়িয়ে দিন। দেখবেন কয়েকদিনের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাবেন৷
মরিচ গাছের যত্ন খুব সহজ। শুধুমাত্র জৈবসার প্রয়োগ করেই গাছকে সুস্থ্য সবল রাখা যায়। পাতা পচা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করলে পাওয়া যায় আরও ভালো ফলন। মরিচ গাছের জন্য রোদ অপরিহার্য। ছাদে বা বেলকনি যেখানেই রাখুন, গাছ যাতে পর্যাপ্ত রোদ পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মাটির আর্দ্রতা বুঝে গাছে পানি দেবেন। মাটিকে কখনো শুকনো অবস্থায় রাখা যাবে না। মরিচ গাছের নিচে সুযোগ পেলেই পিঁপড়ার দল বাসা বাধে। এজন্য পিঁপড়ার বিষ টবের চারপাশে দিয়ে রাখুন।
মরিচের বহুবিধ গুণ
কাঁচা মরিচে থাকে আয়রন, থিয়ামিন, ডায়াটারি ফাইবার, সোডিয়াম, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, কপার, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন এ, সি, কে, বি৬, পটাসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। এগুলো শরীরের ডায়বেটিস, সাইনাস, কলোস্টরেলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এতে বিদ্যমান অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়।
পরমবন্ধু আদা
শহরে আদা চাষের কথা শুনে অনেকে বিস্মিত হতে পারেন৷ কিন্তু আদার মতো উপকারি উদ্ভিদ আপনার বারান্দা বা ছাদে খুব সহজেই চাষ করতে পারেন৷ আদা গাছের পাতা বেশ নান্দনিক। আপনার বাগানের সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি এটি ফলও প্রদান করবে। আদা গাছ উচ্চতায় ২-৩ ফুট হয়৷ অল্প যত্নেই আদা গাছ বেড়ে ওঠে।
যেভাবে করবেন আদা চাষ
প্রথমে আদাকে পলিথিনে ভরে ফ্রিজে কয়েকদিন রাখুন। এতে চোখ উঠলে বুঝতে হবে সেই অংশ রোপণের উপযোগী হয়েছে। একটি আদাকে ৭-১০ টুকরো করে নিতে পারেন তবে লক্ষ্য রাখতে হবে প্রতি অংশে যেন একটি ছোটো গাছ বা চোখ থাকে। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট পানিতে মিশিয়ে হালকা দ্রবন তৈরি করে আদাকে ভিজিয়ে রাখলে এর অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে। তাছাড়া রোপণের আগে ছত্রাকনাশকেও কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখতে পারেন, এজন্য সাফ পাউডার (saaf) ব্যবহার করতে পারেন। এর ফলে পরবর্তীতে গাছ ছত্রাক জনিত রোগে আক্রান্ত হবে না৷
আদা চাষের জন্য বড় আকারের টব বা প্লাস্টিকের বস্তা নির্বাচন করুন। ঝুরঝুরে মাটি এর জন্য আদর্শ। মাটি তৈরিতে ৪০% গার্ডেন সয়েল, ৩০% কম্পোস্ট সার, ৩০% মোটা বালি মেশাবেন। মাটিতে পোকার আক্রমণ রোধে ২ চামচ নিম খৈল ব্যবহার করুন। ১০ কেজি মাটির জন্য ২ চা চামচ ইউরিয়া, ৩ চা চামচ ডিএপি, ১ চা চামচ জিপসাম, কোয়ার্টার চা চামচ বোরন দিলে আদা গাছে পুষ্টির ঘাটতি পড়বে না৷ বীজ থেকে চারা অঙ্কুরিত হতে সাধারণত ৩০-৪৫ দিন লাগে।
আদা গাছের তেমন কোনো যত্ন নিতে হয় না। নিয়মিত পানি প্রদান ও আগাছা দমন করলে গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠে। আদার ফল পরিপক্ব হতে ৯-১০ মাস সময় লাগে। ৪-৫টি আদা গাছ থেকে প্রায় ২ কেজি আদা পাওয়া যায়৷
আদার অসীম গুণ
আদায় রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন সি, আয়রন, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, দস্তা, ফসফরাস, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ফোলেট, ক্যালরি ও কার্বোহাইড্রেট। বিভিন্ন ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আদায় বিদ্যমান অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আমাদের রক্ষা করে। সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, হজম শক্তি, বমি ভাব, বাতের ব্যথা এমনকি মাইগ্রেন ব্যথায় আদা কার্যকরি ভূমিকা পালন করে৷
সহজলভ্য হলুদ
হলুদ আদা পরিবারের অন্তর্গত গুল্ম প্রজাতির গাছ। এটি দক্ষিণ এশিয়ার উদ্ভিদ৷ ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকেই হলুদের ব্যাপক ব্যবহার ও চাষ হয়ে আসছে৷ হলুদ গাছে সুন্দর ফুল ফোটে। লম্বায় হলুদ গাছ ২-৩ ফুট পর্যন্ত হয়। রান্নার কাজে ব্যবহার করা ছাড়াও রূপচর্চা ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এর বহুল ব্যবহার রয়েছে৷
সহজ পদ্ধতিতে হলুদ চাষ
হলুদ চাষের জন্য বড় টব বা ড্রাম ব্যবহার করাই শ্রেয়। এতে গাছগুলো সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে৷ ছাদে বেড তৈরি করে হলুদ লাগালে অবশ্য ভালো ফলন পাওয়া যায়।
মার্চ থেকে জুলাই মাস হলুদ রোপণের আদর্শ সময়। হলুদের বীজ বাজারেই কিনতে পাওয়া যায়। অথবা ঘরেও আপনি হলুদের চারা তৈরি করতে পারেন৷ এক্ষেত্রে কাঁচা হলুদ ১৫-২০ দিন ছায়াযুক্ত স্থানে রাখলে এটি অঙ্কুরিত হতে শুরু করে। লক্ষ করলে দেখবেন বীজ হলুদের প্রতিটির মাথায় চোখ থাকবে। অপেক্ষাকৃত বড় হলুদের টুকরা মাঝ বরাবর কেটে নিন। এবার ছত্রাকনাশকে হলুদের টুকরো শোধন করে নিন। এজন্য সাফ বা ব্যবিস্টিন ছত্রাকনাশক মাঝারি ধরনের বাটিতে ১ চা চামচ দিয়ে হলুদের টুকরো ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। এবার হলুদের টুকরো শুকিয়ে নিতে হবে। সরাসরি সূর্যালোক পরিহার করে সম্পূর্ণ ছায়াযুক্ত স্থানে ৪৫ মিনিট শুকিয়ে নিন।
বড় টবে মাটি তৈরিতে ৪০% সাধারণ মাটি, মোটা বালি ২০%, এক বছরের পুরনো গোবর সার ৪০%, ১০০ গ্রাম সরিষার খৈল, ২ চা চামচ এনপিকে সার মিশিয়ে নিন। এবার মাটির উপরিভাগে ছাই দিয়ে অঙ্কুরিত ও শোধনকৃত হলুদ রোপণ করুন। রোপণের পর পরিমিত পানি দেবেন। ১ সপ্তাহের মধ্যে হলুদ গাছ বড় হতে শুরু করবে। দেড় মাস পর গাছে মাটি, ছাই, গোবরসার, এনপিকে দিয়ে এর গোড়া বেধে দিলে গাছের বাড়তি ফলন নিশ্চিত হয়। ৬-৭ মাস পরে গাছ মরে গেলে হলুদ সংগ্রহ করা যায়।
হলুদের যতসব গুণাবলি
হলুদে ভিটামিন ‘বি-৬’, ‘সি’, ‘ই’ এবং ‘কে’, জিংক, কপার, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, কারকিউমিন ও ক্যালসিয়াম থাকে। লিভারের সুরক্ষায়, হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে হলুদ৷ ক্যান্সার, লিউকেমিয়া, ডায়বেটিস রোগীদের জন্য হলুদ বিশেষ উপকারী। তাছাড়া ত্বকের যত্নেও এর ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে৷
উপকারী উদ্ভিদ রসুন
রসন একবীজপত্রী বহুবর্ষজীবী সম্পূরক উদ্ভিদ। এতে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণ৷ প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় মসলা হিসেবে নয় বরঞ্চ ভেষজ হিসেবে রসুনের চাষ করা হতো৷ বর্তমানে প্রাত্যহিক রান্নার কাজে রসুনের ব্যবহার হচ্ছে। রসুন চাষ খুব সহজ হওয়ায় আপনার বাড়িতে অল্প জায়গা, এমনকি টবে এর চাষ সম্ভব।
রসুন চাষের সহজ উপায়
অক্টোবর-নভেম্বর, ফেব্রুয়ারি-মার্চ রসুন উৎপাদনের উপযুক্ত সময়। রসুনের চারা উৎপাদনের জন্য বাজারের রসুন নির্বাচন করতে পারেন। রসুনের একটি কোয়া থেকে চারা হয়৷ বাড়িতে থাকা টব বা বড় প্লাস্টিকের গামলায় রসুন চাষ করা যায়।
রসুন শক্ত মাটিতে বেড়ে উঠতে পারে না, এর জন্য প্রয়োজন নরম ও ঝুরঝুরে মাটি। ৭০% বেলে দোআঁশ মাটিতে ৩০% গোবর সার বা ভার্মি কম্পোস্ট ভালোভাবে মিশিয়ে মাটি তৈরি করা যায়। রাসায়নিক সারের প্রয়োজন পড়ে না৷ ৩-৪ ইঞ্চি পরপর রসুনের কোয়া রোপণ করবেন। বেশি ঘিঞ্চি করে লাগালে এর চারা সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। মাসে একবার খৈলপচা পানি দিলে এর বৃদ্ধি দ্রুত হয়। তাছাড়া ১৫ দিন পরপর তরল জৈব সার ব্যবহার করা যায়। রসুনের ফলন আসতে সাধারণত ৯০-১১০ দিন সময় লাগে।
রসুনের উপকারিতা
রসুনে রয়েছে ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৬, ফোলেট, সেনেরিয়াম, এলিসিন। এজন্য রসুনকে ‘সুপার ফুড’ বলা হয়। রসুন পুরুষের যৌন ক্ষমতা বাড়াতে, হাড়ের ক্ষয়রোধ, স্বাভাবিক রক্তসঞ্চালন, ফুসফুসের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কর্যকরী ভূমিকা রাখে। হার্টের সুরক্ষায়, অ্যাজমা ও শরীরের ত্বক সুন্দর রাখতে ভুমিকা রাখে।
সুবাস ছড়ানো ধনিয়াপাতা
ধনিয়া অত্যন্ত সুস্বাদু ও জনপ্রিয় গাছ। রান্নাকে সুস্বাদু ও ঘ্রাণ যুক্ত করতে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখে এটি৷ এর আদি জন্মস্থান দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা। এটি বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। সাধারণত এর বীজকে মসলা হিসেবে ও পাতাকে সালাদ বা রান্নার সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ধনিয়া চাষের সহজ উপায়
বাসার ছাদ বা বারান্দা যেখানে প্রচুর আলো-বাতাস পাওয়া যায়- এমন স্থান ধনিয়া চাষের জন্য উপযুক্ত। বর্ষাকাল ব্যতীত সারা বছরই ধনিয়া চাষ করা যেতে পারে। প্লাস্টিকের বোতল, টব, বা বস্তায় মাটি ভরে ধনিয়ার চারা লাগাতে পারেন। একটি মাঝারি আকৃতির টবে ১০০টি চারা রোপণ করা সম্ভব।
প্রায় সবধরনের মাটিতে এটি চাষ করা যায়। তবে বেলে দোআঁশ ও এটেল মাটি ধানিয়া পাতা চাষের জন্য বেশি উপযোগী। গার্ডেন সয়েলে ভার্মি কম্পোস্ট ও পুরনো পচা গোবর সার মিশিয়ে মাটিকে আগলা ঝুরঝুরে করে নিতে হবে৷ বাজার থেকে কেনা বীজ রোপণ করতে পারেন। অথবা বাড়িতে থাকা ধনিয়া ১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে এতে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে। এটি বেশ সময় সাপেক্ষ ও জটিল হওয়ায় এ পদ্ধতিতে না আগানোই ভালো৷ টবে বীজ রোপণের সময় লক্ষ রাখবেন বীজ যাতে ঘন না হয়।
ধনিয়ার উপকারিতা বহু
ধনিয়া পাতায় রয়েছে ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’, ‘কে’, আয়রন, ফসফরাস, ক্লোরিন, প্রোটিন, বিভিন্ন ধরনের অ্যাসিড, ১০-১১ রকমের অ্যাসেনশিয়াল ওয়েল। দেহের ক্ষতস্থান শুকাতে, কোলস্টরেল এর মাত্রা কমাতে, ত্বকের সৌন্দর্য বর্ধনে, চুলপড়া রোধে, বায়ুনাশক হিসেবে ধনিয়া পাতা অত্যন্ত ভালো কাজ করে৷
ছাদ বা বারান্দায় এলাচ বাহার
এলাচ এক ধরেনর সুগন্ধি ফল। ঝাল কিংবা মিষ্টি যেকোনো খাবারের স্বাদ বাড়াতে এর জুড়ি নেই। দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এলাচের আদি জন্মস্থান। এলাচ গাছ দেখতে অনেকটা আদা গাছের মতোই তবে এর গোড়া থেকে লম্বা ফুলের ছড়ি বের হয়, এই ফুল থেকেই এলাচের জন্ম।
সহজ পদ্ধতিতে এলাচের চাষ
সাধারণত দুইভাবে এলাচের চাষ করা যায়৷ বীজ থেকে ও চারা থেকে। তবে বাজারের এলাচ থেকে কোনোভাবেই চারা তৈরি করা যাবে না। এর জন্য আলাদা বীজ রয়েছে৷ একটি গাছকে শিকড়সহ অন্যত্র রোপণ করলে তার গোড়া থেকে নতুন চারা বের হয়। এভাবে এর বংশবিস্তার করা যায়৷
এলাচ স্যাতস্যাতে মাটিতে ভালো জন্মে। টবের জন্য ৬০% গার্ডেন সয়েল, ২০% মোটা বালি, ১০% ভার্মি কম্পোস্ট, ১০% কোকোপিট ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে৷ ১০-১২ ইঞ্চি মাপের বড় টব এলাচের জন্য ভালো। টবের ড্রেনেজ সিস্টেম যাতে ভালো থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এবারে টবে মাটি বসিয়ে তাতে এলাচের চারা রোপণ করতে পারেন। গরমের দিনে ৩-৪ ঘন্টা সূর্যের আলোতে রাখবেন বাকি সময় হালকা সেডে রাখবেন। তবে শীতের দিনে ৬-৭ ঘন্টা সূর্যের আলোতে রাখতে পারেন৷
এলাচের গুণাগুণ
এলাচে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ফাইবার, রিভোফ্লোভিন, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালরি, ফ্যাট ইত্যাদি বিদ্যমান। এলাচ পরিপাকতন্ত্র ভালো রাখে, হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করে, সর্দিকাশি থেকে মুক্তি দেয়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, ক্ষুধা বাড়াতে, ত্বককে ভালো রাখতে, চুল পড়া রোধে, এমনকি ক্যানসারের সেল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ভিনদেশী লেমন গ্রাস
লেমন গ্রাস বা থাই পাতা বর্তমানে বিভিন্ন থাই কন্টিনেন্টাল রান্নায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দ্বীপ অঞ্চলের উদ্ভিদ। ঘাসের মতো দেখতে এর পাতা বিশেষ করে থাই স্যুপে ভিন্নমাত্রা যোগ করবে। ঘাসের মতো ঝোপাকৃতি এই গাছ যেমন রান্নার কাজে লাগে তেমনি এর থেকে চা, তেল ও ভেষজ উৎপন্ন হয়।
লেমন গ্রাস রোপণ পদ্ধতি
গাছটিকে খুব সহজেই টবে রোপণ করতে পারেন। এর জন্য আলগা ঝুরঝুরে গার্ডেন সয়েল ৫০%, মোটা বালি ২০%, কোকোপিট ২০%, ভার্মি কম্পোস্ট ১০%, অল্প পরিমাণ হাড়ের গুড়া, শিং কুচি একত্রে ভালোভাবে মিশিয়ে নেবেন। কোকোপিট পানি ধরে রাখতে সক্ষম। হঠাৎ পানি দিতে ভুলে গেলে এরা মাটিকে আর্দ্র রাখবে৷ ১০-১২ ইঞ্চি টব নির্বাচন করবেন ও ভালোভাবে এর ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরি করে নেবেন৷ লেমন গ্রাসের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে।
লেমন গ্রাসের অজানা উপকারিতা
লেমন গ্রাসে থাকে থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন পান্টোথেনিক অ্যাসিড, ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, সোডিয়াম, দস্তা, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি৷ লেমন গ্রাসের চা বেশ জনপ্রিয় পানীয়। উচ্চরক্তচাপ, ঠান্ডা, কাশি, হজমে সহায়তা, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ত্বক ও চুলের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এর ভূমিকা রয়েছে।
বিখ্যাত চুইঝাল
খুলনার বিখ্যাত মসলার গাছ চুইঝাল। এটি ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও মালোয়শিয়ায় জন্মে। বর্তমানে মাছ ও মাংস রান্নায় এটি বহুল ব্যবহৃত হয়। এটি দেখতে অনেকটা পান গাছের মতো। এর পাতায় ঝাল থাকে না। গাছের কান্ডটিই মূলত চুইঝাল। রান্নাকরা চুই চিবিয়ে খেলে অন্যরকম স্বাদ পাওয়া যায়, যা খাবারের স্বাদে ভিন্নমাত্রা যোগ করে।
চুইঝাল চাষের প্রক্রিয়া
চুই গাছে ফুল ফুটে এবং বীজ হয়৷ এসব বীজ দিয়ে চুই গাছের বংশবৃদ্ধি সম্ভব৷ তাছাড়া বংশবৃদ্ধি করতে এর কাটিং ব্যবহার করতে পারেন৷ গাছের বড় ডালের যে অংশে গিটের মতো থাকে সেটা একটু নিচ বরাবর কেটে মাটিতে লাগিয়ে দিলেই নতুন চারা গজায়৷
চুই গাছের জন্য বড় আকারের টব অথবা প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার করতে পারেন৷ মাটি তৈরির জন্য ৬০% গার্ডেন সয়েল, ২০% গোবর সার, ২০% ভার্মি কম্পোস্ট এতে ৩০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০ গ্রাম পটাশ, ২০% টিএসপি মিশিয়ে নেবেন। তবে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করাই ভালো। যেহেতু এর ডাল ও কান্ড মসলা হিসাবে ব্যবহৃত হবে এজন্য পুরোপুরি অর্গানিক সার ব্যবহারের চেষ্টা করবেন। টবের গাছের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি যত্ন লাগে, প্রতিমাসে একবার গাছে খৈল পচা পানি দেবেন।
চুইঝালের উপকারিতা
চুই গাছে পিপালারটিন, অ্যাকালয়েড, সুগন্ধি তেল, পোপিরন, পোলার্টিন, গ্লাইকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সিজামিন, পিপলাসটেরল ইত্যাদি রয়েছে। এটি গ্যাস্টিক, বদহজম, মানসিক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ, পাকস্থলীর বিভিন্ন প্রদাহ, খাবারে অরুচি ও অনিদ্রা দূর করে।
সুগন্ধী জয়ফল
জয়ফল সুগন্ধ জাতীয় মসলা। এটি ইন্দোনেশিয়ায় সর্বপ্রথম চাষ হয়। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এর ব্যবহার দেখা যায়। বাংলাদেশে বিরিয়ানি বা মাংসের রান্নায় এর ব্যবহার করা হয়।
জয়ফলের উৎপাদন পদ্ধতি
জয়ফল ১০-১২ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। সাধারণত এরা এককান্ড বিশিষ্ট গাছ। গাছটি দেখতে অনেকটা কাটিং করা ঝাউগাছের মতো। গাছ রোপণের ৭-৮ বছর পর এর ফল পাওয়া যায়। সঠিকভাবে সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা করলে বছরে ১০০০ এর মতো ফল পাওয়া যায়।
গাছটি কিছুটা বড় আকারের হওয়ায় একে বড় টব বা ড্রামে রোপণ করা যায়। মাটি তৈরিতে ৬০% সাধারণ মাটির সাথে, ২০% গোবর সার, ২০% ভার্মি কম্পোস্ট মিশিয়ে ঝুরঝুরে মাটি তৈরি করে নিতে হবে৷ তারপর এতে টিএসপি, পটাশ, ইউরিয়া পরিমাণ মতো মিশিয়ে নিয়ে বাছাইকৃত গাছটি প্রতিস্থাপন করবেন। গাছের বয়স যখন ২-৩ বছর হবে তখন মাটিকে সুস্থ রাখতে জৈব সারের পাশাপাশি রাসায়নিক সার দিতে হবে। ইউরিয়া ২০০ গ্রাম, টিএসপি ২৫০ গ্রাম, এমপি ২৫০ গ্রাম, জিপসাম ১০ গ্রাম, বোরন ১০ গ্রাম, দস্তা ১০ গ্রাম প্রদান করতে হবে।
জয়ফলের অসংখ্য উপকারিতা
জয়ফলে প্রোটিন, ক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, থায়ামিন, আয়রন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন ইত্যাদি বিদ্যমান থাকে। শরীরের ব্যথা কমাতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এর তেল ব্যবহার করা হয়। অনিদ্রা, ডায়বেটিস, ওজন কমাতে, দাঁতকে সুস্থ রাখতে, রক্তের কলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে, এমনকি ডিপ্রেশন কমাতেও জয়ফল সহায়তা করে।
পুদিনা
পুদিনা আমাদের দেশের জনপ্রিয় একটি গাছ। মাছ ও মাংস রান্নায় পুদিনা পাতা ভিন্ন স্বাদ ও গন্ধ যুক্ত করে। চাটনি, স্টু, শরবত এমনকি পুদিনা পাতা তামাকের বিকল্প হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। টুথপেস্ট, লজেন্স, ঔষধ, চুইংগাম, মিন্ট চকলেট তৈরি করতে পুদিনার পাতা ব্যবহার করা হয়। এর পাতায় রয়েছে মেন্থল।
পুদিনা চাষ পদ্ধতি
এরা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। বারান্দা বা ছাদে খুব সহজেই এর চাষ করা যায়৷ প্রথমে অগভীর টব নির্বাচন করুন। যাতে গাছের শিকড় মাটির খুব বেশি গভীরে যেতে পারে না। ৩-৪ ইঞ্চি টব বা মাটির পাত্র পুদিনা চাষের জন্য যথেষ্ট।
কাটিং থেকে এর বংশবিস্তার ঘটানো যায়৷ ভালো মানের কাটিং সংগ্রহ করে ককোপিটে রোপণ করে ১০-১২ দিন নিয়মিত পানি স্প্রে করলেই পুদিনার চারা পাওয়া যায়। এবার কিছুটা বড় টব বা পাত্রে নতুন চারাগুলো প্রতিস্থাপন করতে হবে। মাটি তৈরি করতে গার্ডেন সয়েল ৪০%, এক বছরের পুরনো গোবর সার ৪০%, আর ২০% ককোপিটের সাথে পরিমাণ মতো হাড়ের গুড়া, শিং কুচি, শঙ্খের গুড়া, অল্প পরিমাণ নিম খৈল ভালোভাবে মিশিয়ে মাটিকে আলগা ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে৷ এবার নির্বাচিত চারাগুলো রোপণ করতে পারেন।
পুদিনার উপকারিতা
পুদিনায় ভিটামিন ‘এ’, ‘বি-কমপ্লেক্স’, ‘সি’, ম্যাংঙ্গানিজ, আয়রন, পটাসিয়াম ইত্যাদি রয়েছে৷ গলা খুশকুশ, কাশি, ত্বক ভালো রাখতে, মাথা ব্যথা কমাতে, ফুসফুস ভালো রাখতে, মুখের ব্রণ কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে পুদিনা।
নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতাকে ছাপিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে আপনি কিছু গুল্ম বা বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ চাষ করতে পারেন সহজেই। যা আপনার বারান্দা বা ছাদে স্বল্প পরিসরেই চাষ করা সম্ভব৷ এসবের পরিচর্যার জন্যও আপনাকে তেমন আহামরি সময় ব্যয় করতে হবে না। সর্বোপরি, বারান্দা বা ছাদে এমন উদ্ভিদ চাষ আপনাকে এক নান্দনিক পরিবেশে মজিয়ে রাখবে।