ছাদ হোক সবুজ উদ্যান

দ্রুত নগরায়নের ফলে কমে যাচ্ছে গাছপালা। নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন। ইট পাথরের দালানের মাঝে নির্মল প্রকৃতি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু মানুষ এর মাঝেও ছাদে কিংবা বারান্দায় গড়ে তুলছে শখের বাগান, নগর জীবনে এক টুকরো সবুজের প্রশান্তি। ছাদ বাগান যেমন আপনাকে প্রশান্তি দেবে ঠিক তেমনি ফুল,ফল, সবজির চাহিদা মেটাবে। সেইসাথে আপনি বা আপনার পরিবার পাবেন বুকভরা শ্বাস নেওয়ার সুযোগ। চাইলেই ছাদকে বানিয়ে ফেলা যায় সবুজ স্বর্গোদ্যান। খুব সহজ কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখলে আপনিও আপনার ছাদে গড়ে তুলতে পারবেন অনিন্দ্য বাগান।

ছাদ বাগানের ইতিহাস

আধুনিক যুগে আমরা ছাদ বাগান দেখলেও এটি অনেক প্রাচীন একটা ধারণা। প্রাচীন যুগে ছাদে বাগান করার রীতি ছিলো। যিশু খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে মেসোপটেমিয়া যুগে পারস্যের জুকুরাক পিরামিড আকৃতির উঁচু পাথরের স্থাপনায় গাছ লাগানোর নিদর্শন পাওয়া যায়। কায়রো শহরে কয়েক শতক প্রাচীন বিল্ডিংয়ের ছাদে বাগান তৈরি হতো। বিভিন্ন প্রাণীর শক্তির সাহায্য চাকা ঘুরিয়ে ছাদের উপরে পানি সেচের ব্যবস্থা ছিল। এসব প্রাচীন বিল্ডিংগুলো প্রায় চৌদ্দ তালা পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাচীন ইরাকের শহর মাসুলে ছিলো ঝুলন্ত উদ্যান৷ খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তিরে সম্রাট নেবুচাদনেজার তার পত্নীর জন্য গড়ে তুলেছিল ঝুলন্ত উদ্যান। মাটি থেকে  উচ্চতা ছিল ৮০ ফুট। এটি তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে বড় ও বিস্ময়কর ফুলের বাগান। ৫-৬ হাজার মনোমুগ্ধকর ফুলের চারা রোপণ করা হয়েছিল। বাগান পরিচর্যার জন্য ছিল ১০৫০ জম মালী। নদী থেকে বিশেষ কায়দায় পানি তুলে সুউচ্চ বাগানে সেচ দেওয়া হতো। পারস্য রাজ্যের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধে এই বাগান পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। 

কেন করবেন ছাদ বাগান

আমাদের দেশের রাজধানী শহরের  উদাহরণ দেওয়া যাক। ঢাকায় সমতলে গাছের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। পুরো ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে দালানকোঠা। ইস্পাত, ফাইবার উন্নতমানের টেকসই গ্লাস দিয়ে নির্মিত হচ্ছে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। সূর্যের তাপ এসব ধাতব ও কাঁচের উপর পড়ে অপরটিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। পৌনঃপুনিক এসবের ঘটনা ঢাকাকে পরিণত করছে হিট আইল্যান্ডে। ঢাকার পরিবেশ দূষণ বিশ্বের অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় অনেক বেশি। অধিক জনসংখ্যা, জলাধার কমে যাওয়া, দ্রুত নগরায়ন, অধিক হারে গাছপালা নিধন ঢাকাকে ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, ১৯৮৯ সালে ঢাকা শহরের গাছপালার পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যা ধীরে ধীরে কমে ১৯৯৯ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে৷ অন্যদিকে ১৯৮৯ সালে ঢাকা শহরের বাৎসরিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১৮ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ২০০৯ সালে বেড়ে হয়েছে ২৪ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু গাছ লাগানোর পর্যন্ত জায়গা নেই, এমন পরিস্থিতিতে ছাদ বাগানের বিকল্প নেই। ছাদ বাগান ঢাকার ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমাতে সক্ষম। তাছাড়া পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করবে। ছাদে ফুল, ফল, সবজি, ঔষধি ও বনজ গাছ রোপণ করা যায়। ফুল, বনজ গাছ সৌন্দর্য বাড়াবে, ফল ও সবজি গাছ থেকে পাবেন রাসায়নিক, কীটনাশক মুক্ত ফ্রেশ ফল, সবজি এগুলো আপনার পরিবারের পুষ্টির সহায়ক ভূমিকা রাখবে। ঔষধি গাছ ভেষজ উপাদানের চাহিদা মেটাবে।

ছবি: মো. শাহ পরান

পরিকল্পিত ছাদ বাগান ও চারা নির্বাচন

জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় প্রয়োজন পরিকল্পিত ছাদ বাগান। দূষণ মুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে এর বিকল্প নেই। ছাদে বাগান করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে এর গাছগুলো যেন বড় না হয়, দেশি গাছ পরিহার করে হাইব্রিড জাতের চারা নির্বাচন করতে হবে। বেটে প্রজাতির দ্রুত বর্ধনশীল গাছ নির্বাচন করতে হবে। বাড়ির ছাদ অধিক পুরাতন হলে চলবে না। ৩০-৪০ বছরের পুরাতন অথবা নতুন বিল্ডিং এর ছাদ, ছাদ বাগানের জন্য উত্তম। 

ফলজ গাছের ক্ষেত্রে হাইব্রিড বা কলম করা আম্রপালি ও মল্লিকা জাতের আম, পেয়ারা, আপেল কুল, জলপাই, করমচা, শরিফা, আতা, আমড়া, লেবু, ডালিম, পেঁপে, এমনকি কলা গাছও চারা নির্বাচন করুন। বর্তমানে টবে আলফানসো, বেঁটে প্রজাতির বারোমেসে, লতা, ফিলিপাইনের সুপার সুইট, রাঙ্গু আই চাষ করা যেতে পারে।  লেবুর মধ্যে কাগজি লেবু, কমলা, মালটা, নারকেলি লেবু, কামকোয়াট, ইরানি লেবু, বাতাবি লেবু খুবই ভালো হয়।

তাছাড়া কলম করা জলপাই, থাইল্যান্ডের মিষ্টি জলপাই, কলমের শরিফা, কলমের কদবেল, ডালিম, স্ট্রবেরি, বাউকুল, আপেলকুল, নারিকেলকুল, লিচু, থাইল্যান্ডের লাল জামরুল, গ্রিন ড্রপ জামরুল, আপেল জামরুল, আঙ্গুর পেয়ারা, থাই পেয়ারা, ফলসা, খুদে জাম, আঁশফল ,জোড় কলমের কামরাঙা, এমনকি ক্যারালা ড্রফ প্রজাতির নারিকেলের চারা রোপণ বা সংগ্রহ করতে পারেন।

ফুলের মধ্যে সিজনাল ও বারমাসি ফুল নির্বাচন করুন। রজনীগন্ধা,গন্ধরাজ, জিনিয়া, সূর্যমুখী, দোপাটি, মণিকুন্তলা, মাধবীলতা, দোপাটি, হাইড্রেঞ্জিয়া, জুঁই, পত্রলেখা, গোলাপ, পিটুনিয়া, ক্যামেলিয়া, ভারবেনা, ডালিয়া, কারনেশন, স্যালভিয়া, জারবেরা, অলকানন্দা, কাঠগোলাপ, কাঞ্চন, জবা, সন্ধ্যামালতি, করবী, জয়তী, সাদা কাঞ্চন ইত্যাদি ফুল লাগাতে পারেন। তবে দীর্ঘজীবী ফুল চাইলে গোলাপ, ক্যামেলিয়া, কাঞ্চন, জবা, বেলী, জুঁই, মুসেন্ডা, চাপা, ব্রানফেলসিয়া, অ্যালামন্ডা, পোর্টল্যান্ডিয়া, টগর, বকুল,  শিউলি সংগ্রহ করতে পারেন। 

ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে সুপরিচিত থাককুনি, পুদিনা, তুলসী, বাসক, বিলম্ব, কলকেশী, তকমা, পাথরকুচি, চিরতা, নিম, বনজুঁই, সজনা, রোজমেরি, চামোমেলি, লেমন বাম, হলুদ, সেজ, আদা, শিউলি, আমলকি, ঘৃতকুমারী, অশ্বগন্ধা, মেথি, শতভরি, সাদা মুসলি, ধুতরা, জবা ইত্যাদি রাখতে পারেন। এগুলো টবে বা ড্রামে খুব সহজেই বেড়ে উঠে।

বাগানের জন্য যা প্রয়োজন

সাধারণত বাগান তৈরির জন্য নানাপ্রকার উপকরণ প্রয়োজনীয় হলেও নিচের ৫টি ধাপ অনুসরণ করে সহজেই ছাদ বাগান তৈরি করা সম্ভব।

মাটি তৈরি

বেডে চারা রোপণ করা হোক অথবা টবে মাটি ছাদ বাগানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান৷ মাটির ঘনত্ব যত বেশি হবে গাছ ততবেশি পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করতে পারবে। দো-আঁশ মাটি ছাদ বাগানের জন্য উপযুক্ত। এঁটেল মাটি হলে তাতে বেলে মাটি আর বেলে মাটি হলে তাতে এঁটেল মাটি মিশিয়ে ঝুরঝুরে করে দো-আঁশ মাটিতে রূপান্তর করুন। জৈব সার প্রয়োগ করতে চাইলে ভার্মিকম্পোট অথবা গোবর সার ব্যবহার করবেন। রাসায়নিক সারের ক্ষেত্রে ২ ফুট বাই ২ ফুট ১.৫ ফুট আকারের গর্তে হাফ ড্রামে প্রায় ১২০-১৫০ কেজি (৩-৪ বস্তা প্রায়) মাটি ধরে। উভয়ক্ষেত্রে মাটির সঙ্গে ৩০-৫০ কেজি জৈব সার, ১২০-১৫০ গ্রাম টিএসপি, ৮০-১০০ গ্রাম  পটাশ, ৪০-৫০ গ্রাম  জিপসাম, ১০-১৫ গ্রাম করে বোরণ ও দস্তা সার ভালোভাবে মিশিয়ে ১৫ দিন ঢেকে রাখবেন। এরপর মাটি ভালোভাবে নেড়েচেড়ে কিছুক্ষণ খোলা অবস্থায় রেখে চারা রোপণ করবেন। নেমোটেড বা কৃমি জাতের ছত্রাক নিধনে উপরোক্ত পরিমাণ মাটির সঙ্গে ১০ গ্রাম হারে দানাদার কীটনাশক এবং কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাক নাশক মিশিয়ে দিতে পারেন। দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করতে না চাইলে বায়োডার্মা সলিড প্রয়োগ করবেন।

বেড তৈরি

ছাদে জলছাদ না থাকলে আলকাতরার প্রলেপ লাগিয়ে নিন। এরপর মোট পলিথিনের নিয়ে ঢেকে দুই ফুট মাটির স্তর রাখুন। ফ্রেম তৈরি করতে কাঠ, লোহা, রাবার,স্টিল ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। পুরনো বেড পরিহার করতে হবে। ৩-৪ বছর পরপর বেড পরিবর্তন করতে হবে। আপনি চাইলে স্থায়ী বেড তৈরি করতে পারেন। এতে খরচ খুব বেশি নয়। পুরু পলিথিন দিয়ে ছাদ ঢালাই করলে ড্যাম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এক্ষেত্রে চার ফুট দৈর্ঘ্য, চার ফুট প্রস্থ ও দুই ফুট উচ্চতার বেড নির্মাণ উত্তম। 

হাফ ড্রাম ও চৌবাচ্চা

অনেকে মনে করেন ছাদে ড্রামে গাছ রোপণ ঠিক নয়, এ ধারণা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বড় আকারের ড্রাম মাঝ বরাবর কেটে দুইটা টব বানানো যায়। বড় জাত কিংবা ফল গাছের জন্য ড্রাম ভালো। রিং স্লাব দিয়ে খুব সহজেই চৌবাচ্চা তৈরি করা যায়। রিং স্লাব এর নিচে সিসি ঢালাই দিয়ে স্থায়ী চৌবাচ্চা তৈরি করা যায়। এতে বিভিন্ন গাছ ছাড়াও জলজ উদ্ভিদ ও মাছ রাখা যায়। 

টব

টবে চারা রোপণের জন্য গাছার আকার ও টবের আকৃতির প্রতি বিশেষ নজর রাখতে। উদ্ভিদ ভেদে টব নির্বাচন করুন। মনে রাখতে হবে গাছের শিকড় যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়। টবে চারা রোপণের আগে টব ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো। এতে গাছের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়৷ ছোট আকারের চারা খুব সহজেই টবে রোপণ করা যায়। চারাটি বড় হলে টব থেকে কিছু কৌশল অবলম্বন করে অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে। এক্ষেত্রে টবে ভেঙ্গে চারা স্থানান্তর করা যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় গাছের অনুপাতে টব বাছাই করলে। যার ফলে গাছটি স্থায়ী ভাবে টবে থাকতে পারবে। পানি নিষ্কাশনের জন্য অবশ্যই টবের নিচে ছিদ্র রাখবেন৷ 

ছবি: মো. শাহ পরান

সেচ বা পানি প্রদান

অতিরিক্ত পানি প্রদান যেমন গাছের জন্য ক্ষতিকর তেমনি সেচের অভাবে গাছটি মারা যেতে পারে। মাটির আর্দ্রতার উপর নির্ভর করে সেচ বা পানি দিতে হবে। ছাদ বাগানের জন্য ঝাঁঝরি দিয়ে সেচ দেওয়া উত্তম। চিকন প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমেও পানি দেওয়া যাবে। পাইপের ডেলিভারি মাথা চেপে ধরে হালকা ভাবে পানি ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। 

কিছু টিপস

  • ফলজ বড় গাছকে পিছনের দিকে রাখবেন পক্ষান্তরে ছোটো গাছগুলো সামনের দিকে রাখবেন, এতে সূর্যের আলো ও তাপ ঠিকভাবে পাবে। 
  • টব, ড্রাম, বেডে গাছের জাত বিবেচনা করে রাখবেন। 
  • বড় গাছ পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে না দিয়ে পশ্চিম ও উত্তর পাশে দিবেন। 
  • চারা রোপণের পর গাছের গোঁড়ায় পানি ঢালবেন, নতুন গাছে খুঁটি দেবেন। 
  • বর্ষার আগে আগে টবে চারা কলম করতে পারেন। বছরে একবার নতুন মাটি দিয়ে পুরাতন মাটি বদলিয়ে দিতে হবে। এটি অক্টোবর মাসে করাই শ্রেয়।
  • মাঝেমধ্যে চুনের পানি দিতে পারেন। 
  • রোগাক্রান্ত বা অপ্রয়োজনীয় ডাল ছেঁটে ফেলুন। ছাটাইকৃত স্থানে বোর্দ পেস্ট লাগাবেন। (২৫০ গ্রাম তুঁতে ও ২৫০ গ্রাম চুন ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে বর্দোপেস্ট তৈরি করতে পারেন।)

গাছ আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম উপাদান। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও দূষণ কমাতে বৃক্ষ রোপণের বিকল্প নেই।সবাই গাছের বন্ধু হই। গাছ বাঁচলে বাঁচবো আমরা, বাঁচবে আমাদের প্রজন্ম। আসুন একটি সবুজ সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলি।

 

1 thought on “ছাদ হোক সবুজ উদ্যান”

  1. Creative Boy SP

    ধন্যবাদ আমার বাগানের ছবি গুলো আপনাদের ওয়েব সাইটে ব্যবহার করার জন্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *