শহরের অনেক বাসায় তেমন সূর্যের আলো পড়ে না। যার ফলে অনেকেই গাছ রোপণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তবে এমন অনেক গাছ রয়েছে যেগুলো সরাসরি সূর্যের আলো ছাড়া বাঁচতে সক্ষম। এসব গাছ আপনার ঘরের সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি বিশুদ্ধ বায়ু প্রবাহ নিশ্চিত করবে।
১. জেরেনিয়াম
জেরেনিয়াম লাল ও গোলাপি ফুলের গাছ। এর মৃদু মিষ্টি গন্ধ আপনাকে মোহিত করবে। বাসায় একে ইনডোর প্লান্টের মতোই রাখতে পারবেন। জেরেনিয়াম গাছে শীতের মাঝামাঝি থেকে গরম শুরুর কয়েকদিন পর্যন্ত ফুল ফুটে। তবে ঠিকঠাক যত্ন নিলে গরমেও এর ফুল পাওয়া যায়।
জেরেনিয়াম বেলে দো-আঁশ মাটি পছন্দ করে। মাটি তৈরির জন্য ৭০% বেলে দো-আঁশ মাটি, ২০% ভার্মিকম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর সার, ১০% পাতা পচা কম্পোস্ট সার এবং সাথে অল্প পরিমাণে হাড়ের গুড়া মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। ৬-৮ ইঞ্চি টবে উক্ত মাটি এক সপ্তাহ রেখে গাছ রোপণ করবেন। গাছ প্রতিস্থাপন এর পর কিছুটা বড় হলে এনপিকে ২০-২০-২০ প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে খৈল পচা পানি দিতে হবে। সাধারণত জেরেনিয়াম গাছের পাতার রঙ গাঢ় সবুজ, তবে এর গ্রোয়িং পিরিয়ডে পাতার রঙ বিবর্ণ হলে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট (যা ইপসন সল্ট নামে পরিচিত) ২-৩ গ্রাম এক লিটার পানিতে গুলে গাছে স্প্রে করার চেস্টা করবেন। জেরেনিয়াম গাছের আয়ুকাল ৩০-৪০ বছর৷
২. বার্ডস অফ প্যারাডাইস
বার্ডস অফ প্যারাডাইস — অনন্য সুন্দর এই ফুলকে অনেক মানুষ স্বর্গের ফুল মনে করে। বিভিন্ন রঙের যেমন, সাদা, লাল, নীল, হলুদ কমলাসহ অন্যান্য রঙের ফুল হয়ে থাকে। কলাগাছের মতো এই গাছ ৬-১০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। গাছের পাতার রঙ গাঢ় সবুজ। এর ফুল বহির্বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়। বার্ডস অফ প্যারাডাইসকে আমেরিকার লস এঞ্জেলস এর অফিসিয়াল ফুলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
এই গাছের জন্য কিছুটা বেশি জায়গা লাগে, তাই ১২-১৬ ইঞ্চি গভীর টব নির্বাচন করবেন। টবের নিচে ৪-৫ টি ছিদ্র করতে হবে, এই গাছ ড্রেনেজ ভালোবাসে।
মাটির জন্য খুব হালকা মাটি নির্বাচন করবেন যাতে এর ভিতরে খুব সহজেই বায়ু চলাচল করতে পারে৷ গর্ডেন সয়েল ১ ভাগ, নদীর বেলে মাটি ১ ভাগ, ভার্মি কম্পোস্ট ১ ভাগ, ককোপিট ১ ভাগ মিশিয়ে মাটি প্রস্তুত করতে হবে। এই অনুপাতে মাটি তৈরি করলে মাটির ভিতরে খুব সহজেই বায়ু চলাচল করতে পারবে৷ গাছ রোপনের পর প্রয়োজন মতো পানি দিতে হবে।
সবসময় সরাসরি সূর্যালোক এড়িয়ে যেখানে প্রচুর আলো আসে এমন জায়গা নির্বাচন করবেন। বাড়ির বেলকুনি এটি রাখার জন্য আদর্শ স্থান।
গাছে ভালো ফুল ফুটাতে চাইলে সবসময় অর্গানিক সার ব্যবহার করবেন। তবে অর্গানিক ফিড না পেলে অন্তত ২০ দিন পরপর আধা চা চামচ ডিএপি, আধা চা চামচ পটাশ, এনপিকে ২-১-২ আধা চামচ গাছের গোড়া থেকে কিছুটা দূরে প্রয়োগ করুন। দুইদিন পরপর গাছে নিয়মিত পামি দেবেন। যদি মাটির আদ্রতা কমে যায় তাহলে সুবিধামতো পানি প্রয়োগ করবেন।
৩. সিনেরেরিয়া
সিনেরেরিয়া পূর্ণ ছায়াতে থাকতে ভালোবাসে। বহুবর্ষজীবী বুনো এই গাছে সাদা, বেগুনি, নীলচে বেগুনি, বেগুনি ও সাদার মিশ্রিত ফুল ফুটে। উচ্চতায় এই গাছটি ২২-৭৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়।
টব নির্বাচনের জন্য ছোট গাছগুলকে প্রথমে ৪ ইঞ্চি টবে রাখতে হবে। যখন টবের নিচের ছিদ্র দিয়ে এর শিকড় বেরিয়ে যাবে তখন ১০ ইঞ্চির টবে প্রতিস্থাপন করতে করতে হবে।
যেহেতু এটি একটি বুনো ফুল সেক্ষেত্রে এর জন্য প্রাকৃতিক সার সবচেয়ে বেশি উপযোগী। তাই মাটি প্রস্তুতের জন্য ৫০% ভার্মি কম্পোস্ট, ৫০ গার্ডেন সয়েল মিশিয়ে নিবেন। এতে পটাশিয়াম, নাইট্রোজেন, ফসফরাসের চাহিদা মেটাতে অল্প পরিমানে এনপিকে সার প্রয়োগ করবেন। অর্গানিক ভাবে এনপিকে সার তৈরি করতে এক চামচ হাড়ের গুড়া, এক চামচ শিং কুচি ও শুকনা কলার খোসা এক চামচ মাটিতে মেশাবেন। তাহলে মাটি তৈরিতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হবে না৷ গাছ টবে রোপণের পর এর চারপাশে পানি দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে গাছটিতে যেন কোনোভাবেই সূর্যের আলো না পড়ে। সুর্যালোক পড়লে গাছটি মারা যাবে। রাতের বেলায় সিনেরেরিয়া গাছ কে অন্তত ৪-৫ ঘন্টা বৈদুতিক বাতির নিচে রাখা দরকার। এই আলো গাছের গাছের পাতায় পড়লে এর অক্সিন হরমোন গাছের গ্রোথকে বাড়িয়ে দেয়৷ এই গাছে কীটপতঙ্গ তেমন আক্রমণ করে না৷ রোগের মধ্যে গাছ ফাংগাস হয়। ফাংগাস থেকে গাছকে রক্ষার জন্য সাফ (Saaf) পাউডার ২ গ্রাম এক লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়। এই স্প্রে দিনের বেলা করতে হবে। সাফ পাউডার স্প্রে করার ১ সপ্তাহ পর প্ল্যান্টোমাইসিন (১ গ্রাম) এক লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করবেন। এটি মূলত গাছের অ্যান্টিবায়োটিক৷ মিরাকুলান প্লান্ট গ্রোথ (১ এমএল) এক লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর স্প্রে করা গেলে এই গাছে গ্রোথ খুব ভালো হবে ও প্রচুর ফুল আসবে।
৪.ভ্রেসিয়া ক্যারিনাটা
ভ্রেসিয়া ক্যারিনাটার অন্য নাম ফ্লেমিং সোর্ড। এটি এক ধরণের বুনো গাছ। রেইনফরেস্ট জাতীয় বনে এই গাছ বেশি জন্মে। দেখতে সুন্দর গাছটিকে প্রথম দেখাতে আপনার প্লাস্টিরের আর্টিফিশিয়াল গাছ মনে হতে পারে। ফ্লেমিং সোর্ড গাছে একবারই ফুল ফুটে। ফুল আসার পর গাছটি মারা যায়। তবে গাছের ফুলে এর বীজ থাকে যা দিয়ে এর বংশ বিস্তার করা সম্ভব। এর সরাসরি সূর্যালোক প্রয়োজন পড়ে না। ৮-১০ ইঞ্চি টব এর জন্য উপযুক্ত।
মাটি তৈরির জন্য গার্ডেন সয়েল ৫০% গার্ডেন সয়েল, ৫০%ভার্মি কম্পোস্ট ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। আল্প পরিমানে শিং গুড়া, হাড়ের গুড়া, কলার শুকনা খোসা মিশিয়ে নিতে পারেন। কলার শুকনা খোসায় প্রচুর নাইট্রোজেন থাকে। মাটি তৈরি হলে প্রথমে ৪ ইঞ্চির ছোটো মাটির পাত্রে এর বীজ রোপণ করবেন। চারা কিছুটা বড় হলে ৮-১০ ইঞ্চির টবে একে প্রতিস্থাপন করতে করতে হবে।
মাটির আদ্রতা বুঝে এতে পানি দিতে হবে। গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। গাছের গোড়ার অতিরিক্ত পানি ফলে গোড়া পচে গাছ মারা যেতে পারে। গাছের বংশবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে এর ফুল থেকে বীজ সংগ্রহ করা প্রয়োজন। অল্প আলোতে বাঁচতে পারে তাই ঘরের অভ্যন্তরে যেকোনো কক্ষে ফ্লেমিং সোর্ডকে রাখতে পারবেন।
৫.অ্যান্টিরিনাম বা স্ন্যাপড্রাগন
অ্যান্টিরিনাম গাছে হলুদ, কমলা, লাল, মেরুন ও সাদা ফুল ফুটে। এই দুটি প্রজাতি রয়েছে। একটি ঝোপালো অন্যটি লম্বাটে। অ্যান্টিরিয়ামে ঔষধিগুণ রয়েছে। কোলাইটিস ও অশ্বরোগের চিকিৎসায় এর ব্যবহার হয়।
প্রথমে ২-৩ ইঞ্চির মাটির পাত্র, ক্রমান্বয়ে ৬ ইঞ্চি ও প্রপ্তবয়স্ক গাছের জন্য ৮-১০ ইঞ্চির টব ব্যবহার করা উচিৎ। ছোট চারাগাছের জন্য গার্ডেন সয়েল, ভার্মি কম্পোস্ট ও ককোপিট সমপরিমাণ ব্যবহার করবেন। তবে গার্ডেন সয়েল ৬০% ও ভার্মি কম্পোস ৪০% ব্যবহার করেও এর মাটি প্রস্তুত করা যায়। ছোট চারাগুলোতে এনপিকে ২০-২০-২০ স্প্রে করলে বৃদ্ধি খুব দ্রুত হয়। গাছের চূড়ান্ত প্রতিস্থাপন এর জন্য ৪০% গার্ডেন সয়েল, ৪০% ভার্মি কম্পোস্ট, ১০% নদীর বালি, ১০% ককোপিট ব্যবহার করতে হবে। ককোপিট মাটির আদ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
গাছের যত্নে প্রতি ১৫ দিনে একদিন এনপিকে ২০-২০-২০ অথবা এনপিকে ১৯-১৯-১৯ গাছে স্প্রে করতে হবে। মাসে একবার গাছে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্স স্প্রে করলে গাছের বৃদ্ধি সঠিক হবে ও পর্যাপ্ত পরিমাণ ফুল ফুটবে। মাটির আর্দ্রতা দেখে পরিমিত পানি প্রদান করা উচিৎ। অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা রাখতে হবে।