ছাদ বাগানে ৭ ফলজ গাছ

শহরাঞ্চলের তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। ক্রমাগত বৃক্ষনিধন এর অন্যতম কারণ। নতুন দালানকোঠা নির্মাণ ও বায়ু দূষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমতাবস্থায় ছাদ বাগানের বিকল্প নেই, যা সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমাতে পারে। ছাদে বাগান করার জন্য অবশ্যই কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে। ছাদ বাগানের উপযোগী এমন কিছু ফলজ গাছ রোপণ ও এর মাটি তৈরি সম্পর্কে বিস্তারিত এই লেখায়।

ছাদ বাগানে আম চাষ

আম অত্যন্ত সুস্বাদু ফল। আপনার ছাদ বাগানের টবে অথবা ড্রামে এর চাষ করা যায়। এক্ষেত্রে ৩-৪ জাতের আম নির্বাচন করলে ভালো হয়। ছাদ বাগানের জন্য বারি-৩, মল্লিকা ও আম্রপলি বেশ জনপ্রিয়।

ছাদ বাগানে আম চাষ পদ্ধতি

কংক্রিটের টব বা ড্রামে এর চাষ করা যায়। এসব টব বা ড্রামে ১০-১২ বছর আমের ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। কংক্রিটের টব বানাতে টবের দৈর্ঘ, প্রস্থ, উচ্চতা যথাক্রমে ৩২/৩২/৩২ ইঞ্চি হতে হবে। দো-আঁশ মাটি যেকোনো গাছের জন্য বেশ ভালো, তবে আমগাছ সব মাটিতেই জন্মাতে পারে।

টবের মাটি প্রস্তুতের জন্য প্রতি ১০ কেজি মাটিতে, ১ কেজি গোবর, ১ কেজি সরিষার খৈল, ১ কেজি অর্গানিক কম্পোস্ট, ২৫০ গ্রাম হাড়ের গুড়া মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। রাসায়নিক সার এড়িয়ে চলাই ভালো। মাটির মিশ্রণ তৈরি করে ২১ দিন পর গাছ লাগানো উত্তম। গাছ লাগানোর বাঁশের খুটি ব্যবহার করুন। পানি নিষ্কাশনের জন্য টবের নিচে ইট দেবেন। বছরে অন্তত দুইবার গাছে নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করবেন।

গাছে মুকুল আসার তিন মাসের আগে ও পরে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা যাবে না৷ অনেক সময় আমগাছে সাদা তুলার মতো হয়। অনেকেই ভাবেন এটি ফাঙ্গাস। এটি আমগাছের জন্য ক্ষতিকর কীট। তাছাড়া গাছকে কীটপতঙ্গ মুক্ত রাখতে চাইলে রিপকর্ড ১ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে সুফল পাবেন। 

বারমাসি লেবু চাষ ছাদবাগানে

ভিটামিন সি এর অন্যতম উপাদান লেবু। বাড়ির ছাদে লেবু গাছ আপনার সারাবছরের লেবুর চাহিদা পূরণ করবে। সেন্টেড এলাচি, কাগজি, সিডলেস লেবু অন্যতম।

ছাদ বাগানে লেবু চাষে করণীয়

লেবু চাষের জন্য মাঝারি আকারের টব বা ড্রাম নির্বাচন করবেন। বেলে দো-আঁশ মাটি লেবু চাষের উপযোগী। মাটি তৈরির জন্য ২ ভাগ বেলে দো-আঁশ,১ ভাগ গোবর, ১ কেজি ছাই, ২০০ গ্রাম হাড়ের গুড়া, ৩০ গ্রাম পটাশ, ৩০ গ্রাম টিএসপি, ১০ গ্রাম পাথর চুন দিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। ৪-৫ দিন এই মাটির মিশ্রণ রেখে দিয়ে চারা রোপণ করবেন। লেবু গাছ অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না৷ পরিমাণ মতো পানি প্রয়োগ করুন যাতে অতিরিক্ত পানি না জমে।

অনান্য যত্নের মধ্যে গাছের গোড়ায় মাঝে মাঝে নিড়ানি দেবেন৷ তিন সপ্তাহ অন্তর খৈল পচা পানি প্রয়োগ করা লেবু গাছের জন্য ভালো। লেবু গাছ নিয়মিত ছাঁটলে ফলন ভালো হয় ও গাছের সুন্দর বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। 

ডালিম থাকুক আপনার ছাদবাগানে

অনার, বেদানা, ডালিম যেই নামেই ডাকুন এরা একই ফল। এটি অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও সুস্বাদু। ডালিমে পটাসিয়াম, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, প্রোটিন পাওয়া যায়। যা মানবদেহে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে অসামান্য অবদান রাখে।

ছাদবাগানে সহজে ডালিম চাষ পদ্ধতি

ডালিম গাছ রোপণের জন্য ২০ ইঞ্চি গভীর টব বা ড্রাম নিতে হবে। আদর্শ মাটি তৈরিতে ২ ভাগ বেলে দো-আঁশ মাটির মধ্যে যথাক্রমে ১ ভাগ গোবর, ২০০ গ্রাম হাড়ের গুড়া, পটাশ ও টিসপি সমপরিমানে ৮০ – ১০০ গ্রাম মিশিয়ে দেড় সপ্তাহ পরে চারা রোপণ করবেন।

চারা রোপণের আগ মাটিতে নিয়মিত পানি প্রয়োগ করবেন। এরপর মাটি ঝুরঝুরে হলে এতে ডালিমের চারা রোপণ করতে হবে। গাছ রোপণের পর কম পানি দেবেন কয়েকদিন পর স্বভাবিক ভাবে পানি প্রয়োগ করুন। বছরে একবার শিকড়সমেত মটি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এরজন্য ছয় ইঞ্চি গভীরে মাটি পরিবর্তন করবেন। মাটিতে থাকা শিকড় ছেঁটে দেবেন।

গাছের বয়স একবছর হলে এতে ১০ কেজি গোবর সারের পাশাপাশি ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়া, ফসফেট, মিউরেট অব পটাশ প্রয়োগ করুন। গাছের বয়স বাড়ার সাথেসাথে এর মাত্রা বাড়াতে হবে। প্রতিবছর আষাঢ মাসে ও কার্তিক মাসে সার প্রয়োগ করবেন।

ডালিম গাছ আগাছা পছন্দ করে না। গাছের নিচে জন্মানো আগাছা দমন করতে হবে। গাছ নিয়মিত ছাঁটলে এর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। ৮-১০ বছর বয়সে এর ফলন শুরু হয়। নিয়মিত পরিচর্যা নিলে ২০০ অধিক ফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

ছাদবাগানে বড়ই ফলান

বড়ই ভিটামিন সমৃদ্ধ ফল। অনেকেই বড়ইকে কুল বলে সম্বোধন করে। বড়ইয়ে থাকা ভিটামিন সি, এ,বি-২ অনিদ্রা, অস্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালন, লিভারের সমস্যা, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বারি কুল- ১, বারি কুল- ২, বারি কুল- ৩, বাউ কুল- ১, বাউ কুল- ২, আপেল কুল নির্বাচন করুন। এগুলো খেতে খুব সুস্বাদু। 

ছাদবাগানে বড়ই চাষ পদ্ধতি

ছাদ বাগানে টবে কুল চাষের জন্য নিয়মিত জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। ১৮/১৮ ইঞ্চির টব বা ড্রাম বাছাই করুন৷ দো-আঁশ মাটির সাথে ৪০ ভাগ গোবর মিশাতে হবে। এছাড়া মাটিতে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমপি সার মাটিতে মিশাতে হবে। মাটি প্রস্তুতের পর কয়েকদিন অপেক্ষা করুন।

এবার কাঙ্খিত গাছটি রোপন করতে পারবেন। গাছে ফুল আসার আগে কম্পোস্ট ১ কেজি, টিএসপি ২০০গ্ৰাম, এমওপি ১০০গ্ৰাম, ইউরিয়া ৫০ গ্ৰাম, জিপসাম ৫০ গ্ৰাম, রুটন ২০ গ্ৰাম, ট্রাইকোড্রামা ভিরিডি ২০ গ্ৰাম, ট্যাবলেট সার ৫-১০ টি প্রদান করুন৷ গাছে কীটের আক্রমণ দেখা দিলে অবশ্যই কিটনাশক ব্যবহার করতে হবে৷ 

ছাদ বাগানে কমলা

কমলার অন্য নাম ম্যান্ডারিন। বর্তমানে ছাদ বাগানে এর আধিক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। কমলায় রয়েছে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও ফসফরাস। ওজন কমানো, ত্বকের লাবণ্যতা বৃদ্ধি, হার্টকে সুস্থ রাখা, স্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালনে এর বিকল্প নেই।

ছাদবাগানে কমলা চাষ পদ্ধতি

১৮/১৮ ইঞ্চি টব বা ড্রাম কমলা গাছ রোপণের জন্য বেছে নিতে হবে। ৪০ কেজি মাটিতে কম্পোস্ট ১০ কেজি, ইউরিয়া সার ১৫০ গ্রাম, টিএসপি ১০০ গ্রাম, এমওপি সার ১০০ গ্রাম, জিংক সালফেট ১০ গ্রাম ও বোরিক এসিড ৫ গ্রাম মিশিয়ে ১০-১৫ দিন রেখে দিয়ে চারা রোপণ করতে হবে।

প্রতি মাসে একবার ১ চা চামচ এনপিকে সার দিতে হবে। গোড়া থেকে কিছুটা দূরে সার প্রয়োগ করবেন। তাছাড়া এই গাছে গোবর সার প্রয়োগ করতে পারেন।

গাছ ১ মিটার উঁচু হলে এর ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। পাতার রঙ, কাণ্ডের রঙ বাদামী হলে বুঝতে হবে গাছের গেমোসিস রোগ হয়েছে। যে ডালে এই রোগ দেখা দিবে তা ছেঁটে ফেলাই উত্তম। ডাল ছাঁটার পর বোর্দো পেস্ট লাগাবে৷ বোর্দো পেস্ট লাগানোর তৈরির জন্য ১৫০ গ্রাম চুনের সাথে এর অর্ধেক তুত মিশিয়ে নিবেন৷ 

আমলকি ফলান ছাদ বাগানে

আমলকি ফলে রয়েছে অসাধারণ ভেষজ গুনাবলী। চুলের যত্নে প্রাচীনকাল হতে এর ব্যবহার হয়ে আসছে। কোষ্ঠকাঠিন্য, অ্যাসিডিটি সমস্যা, চোখের সমস্যা, রূচি বাড়াতে, হৃদযন্ত্র ফুসফুস ভালো রাখতে আমলকি বেশ উপকারি। তাছাড়া শরীরকে ঠান্ডা রাখতে, ব্লাড সুগারের নিয়ন্ত্রণে এর অবদান রয়েছে৷

ছাদ বাগানে আমলকি চাষ পদ্ধতি

অবশ্যই ভালো মানের আমলকি চারা রোপন করতে হবে। বেলে দো-আঁশ মাটি আমলকি গাছের জন্য উপকারি। ২/২ ফুট টব বা ড্রাম নির্বাচন করতে হবে।

মাটিতে জৈব সার অথবা অর্গানিক কম্পোস্ট ব্যবহার করে প্রস্তুত করতে হবে। এই গাছে রাসায়নিক সারের তেমন প্রয়োজন হয় না। তবে চাইলে টিএসসি ৫০০ গ্রাম, এমওপি ২৫০ গ্রাম ও ২০০ গ্রাম জিপসাম ব্যবহার করতে পারেন। মাটি তৈরি দুই সপ্তাহ পর চারা রোপণ করবেন।  বর্ষাকালে আমলকি চারা রোপনের আদর্শ সময়। চারা রোপনের পর এর গোড়ায় পানি জমতে দেবেন না। চারার বয়স দুইবছর হলে জৈব সারের পাশাপাশি ইউরিয়া ৪০০ গ্রাম, টিএসপি ও এমওপি ৩০০ গ্রাম করে মাটিতে প্রয়োগ করবেন। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সারের মাত্রা বাড়াতে হবে৷

পূর্ণ বয়স্ক আমলকি গাছ থেকে ৫০ কেজি মতো আমলকি পেতে পারেন। 

বিলিম্বি

বিলিম্বি ফল টক স্বাদের হয়ে থাকে। এটি কামরাঙ্গা জাতের উদ্ভিদ। উচ্চরক্তচাপ ও ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ, চুলকানির চিকিৎসায় এর ব্যবহার হয়। খুব প্রচলিত ফল না হলেও দিনদিন এটি জনপ্রিয় হচ্ছে। আমলকি গাছের মতোই এর মাটি তৈরি করতে হবে। ডালপালা আর্দ্র রাখলে এবং নিয়মিত ডালপালা ছেঁটে দিলে সারাবছর ফল পাওয়া যায়। কাঁচা খেতে টক হলেও আচার বা চাটনি বানালে এতে টকভাব থাকে না। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *