বাগানের শোভা: বর্ষাকালীন ১০ ফুল

আপনি যদি সারাবছর জুড়ে আপনার বাগানে ফুলের সমারোহ ঘটাতে চান তাহলে ঋতুভেদে বিভিন্ন ফুলের চাষ করতে পারেন। আমাদের দেশের প্রতিটি ঋতুই অনন্য। যার মধ্যে বর্ষার চিত্র বেশ ভিন্ন। 

বর্ষাকালে রোদ, বৃষ্টি, মেঘের অদ্ভুত খেলা চলে। বৃষ্টি প্রকৃতিকে ধুয়ে মুছে সবুজ করে তোলে। এসময় ফোটে বাহারি ফুল। এসব ফুল আমাদের চোখ ও মনকে প্রশান্ত করে। বর্ষাকালীন ফুলের মধ্যে রেইন লিলি ও ব্লিডিং হার্ট আপনি চাইলে স্বল্প পরিসরে বারান্দা বা ছাদে চাষ করতে পারেন৷ অ্যারোমেটিক জুঁই থাকতে পারে বারান্দায়। অথবা আপনার বাগান যদি সামান্য বড় পরিসরের হয়, সেক্ষেত্রে জানালার পাশেও জায়গা করে দিতে পারেন এটিকে।

ম্যান্ডেভিলা বিদেশি ফুল৷ এটি লতানো উদ্ভিদ। বারান্দার রেলিঙে এটি সবচেয়ে বেশি শোভা পায়। বেগম বাহার ও হাজারি বেলি মাঝারি আকৃতির ফুল হওয়ায় ছাদ বা বাগানের সুবিধাজনক জায়গায় রোপণ করতে পারেন এটি। করবী বিষাক্ত গাছ হওয়ায় এটিকে শিশু ও গবাদিপশুর নাগালের বাইরে রাখা ভালো।

ছাদের এককোণে অথবা বাগানের এমন জায়গা যেখানে শিশু বা গবাদিপশু প্রবেশ করতে পারে না সেখানে করবী রোপণ করাই বাঞ্ছনীয়। ছোট টবে মর্নিং গ্লোরি বারান্দার পাশে শোভা পায় ভালো। অথবা গ্রামীণ পরিবেশে দরজার পাশেও এটিকে রাখা যায়। মাধবীলতা লতানো উদ্ভিদ হওয়ায় এটিকে বারান্দার রেলিঙে রাখা যায়। 

বর্ষার সৌন্দর্য রেইন লিলি

ঘাসের মধ্যে সুন্দর ছোট ছোট ফুল রেইন লিলি। এর তিনটি কালার ভ্যারিয়েন্ট আছে। সাদা, গোলাপি ও হলুদ। রেইন লিলি উচ্চতায় ১৫-২০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। রেইন লিলি প্রতিস্থাপনের সঠিক সময় মার্চ মাস। সারাবছর এর চারা প্রতিস্থাপন করা যায়, কিন্তু এর ফুল পাবেন শুধু বর্ষায়। বৃষ্টির ফোটা এর গায়ে পড়লেই ফুল দিতে শুরু করবে, এজন্য একে রেইন লিলি বলে আখ্যা দেওয়া যায়৷

রেইন লিলির বংশবিস্তার

রেইন লিলির গোড়ায় ছোট ছোট বাল্ব থাকে। এটি দিয়ে এর বংশবিস্তার করা যায়। গাছের জন্য খুব বেশি যত্ন লাগে না। তবে নিয়মিত পানি দিতে হয়। পানির পরিমাণ কম হলে গাছটি শুকিয়ে হলুদ হয়ে যায়।

রেইন লিলির টব ও মাটি নির্বাচন 

১০-১২ ইঞ্চি টব রেইন লিলির জন্য উপযুক্ত। এর বাল্ব থেকে একাধিক বাল্ব জন্মে তাই একটু চওড়া টব নেবেন। বেলে মাটি ছাড়া সব মাটিতেই রেইন লিলি জন্মে।

বর্ষার হৃদয় বিদারক ব্লিডিং হার্ট

সাধারণত জাপান, সাইবেরিয়া, কোরিয়াতে ব্লিডিং হার্ট বেশি দেখা যায়। তবে এর আদি নিবাস আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলে।  অদ্ভুত এই নাম যেন হৃদয়ে রক্তক্ষরণের প্রতীক। ব্লিডিং হার্ট দুই রঙের ফুল দেয়। গোলাপি ও সাদা। গোলাপি ফুলের চেয়ে সাদা ফুল বেশি জনপ্রিয়। প্রষ্ফুটিত এই ফুল সাদা হৃদয়াকৃতির পাপড়ির মাঝে লাল পুষ্প দন্ড দেখে মনে হয় হার্টের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অনন্য সুন্দর গন্ধহীন ফুল। আমাদের দেশে সচারাচর দৃষ্টিগোচর না হলেও অনেক শৌখিন মানুষই দিন দিন এই ফুলের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে। বর্ষায় এই গাছে প্রচুর ফুল ফুটে।

ইনডোর ব্লিডিং হার্ট রোপণ ও পরিচর্যা

৮-১০ ইঞ্চি টবে এই গাছ রোপণ করবেন। প্রায় সব মাটিতেই ব্লিডিং হার্ট ভালো জন্মে৷ গাছের তেমন যত্নের প্রয়োজন হয় না, ঘরের পরিবেশের সাথে সহজেই খাপ খাওয়াতে পারে এরা। গাছের কাটিং করে এর নতুন চারা উৎপাদন করা যায়। নতুন কাটিং থেকে ফুল আসতে প্রায় ১ বছর সময় লাগে।

গাছটি সেমি সেডের গাছ। এর জন্য খুব বেশি সূর্যালোক প্রয়োজন হয় না। সকালের মিষ্টি রোদ গাছের জন্য যথেষ্ট। সরাসরি সূর্যালোকে গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়। ছাদে যেমন সেডে রাখা যায় তেমনি বেলকনিতে গাছটি শোভাবর্ধক হিসেবে কাজ করে। কিছুটা লতানো এই উদ্ভিদে প্রচুর ফুল হয়৷ বেলকুনিতে রাখলে যখন রেলিং এর উপর ঝুলে থাকে তখন দেখতে বেশ সুন্দর লাগে।

বর্ষার বুনোফুল রুয়েলিয়া

বহুবর্ষজীবী গুল্ম প্রজাতির ফুল গাছ রুয়েলিয়া। এটি এক ধরনের বুনোফুল। দক্ষিণ আমারিকায় এর আদি নিবাস। গ্রাম বাংলার অনেকেই একে ‘পটপটি’ ফুল নামে ডাকে। ভ্যারাইটি অনুযায়ী এদের পাতার আকার ও ফুলের রঙে বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। কোনোটির পাতা লম্বা, গোল, সরু হয় আবার ফুলের ক্ষেত্রেও সাদা,  বেগুনি, লাল রঙের ফুল দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে বেগুনি বর্ণের রুয়েলিয়া বেশি দেখা যায়। এরা দলবেঁধে থাকতে পছন্দ করে। যেখানে এরা জন্মে সেখানে একত্রে অনেক গাছ দেখা যায়। ফুলগুলি অনেকটা লাজুক প্রকৃতির। সকালে ফুল ফুটলে দুপুরের মধ্যেই চুপসে যায়।

রুয়েলিয়ার জন্য আলো

রুয়েলিয়া ছায়ার মাঝে থাকতে ভালোবাসে। চাইলে একে ইনডোর প্লান্ট হিসেবে রাখা যায়। রুয়েলিয়ার সুন্দর ফুল মনকে প্রশান্ত করে। এরা সরাসরি সূর্যালোকে থাকতে পারে না। এজন্য রুয়েলিয়াকে অবশ্যই ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে৷

রুয়েলিয়ার বংশবৃদ্ধি ও গুণাগুণ 

৬-৮ ইঞ্চির টবে রুয়েলিয়া প্রতিস্থাপন করা যায়৷ তবে প্রচুর ফুল পেতে চাইলে একাধিক গাছের জন্য বড় টব বেছে নেবেন। রুয়েলিয়া বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। রুয়েলিয়া ছোট ছোট ফল হয়। এগুলো আসলে গাছের বীজ। একটা ফল থেকে প্রায় ২০টি বীজ পাওয়া যায়। ফলটি পানির সংস্পর্শে আসলে ফেটে যায় ও নতুন চারা উৎপন্ন করে। 

রুয়েলিয়ার পাতার রস কন্ঠনালীর অসুখে ও এর শিকড় মুত্রনালীর পাথর অপসারণে সহায়তা করে৷

বর্ষায় মন মাতাবে অ্যারোমেটিক জুঁই

অ্যারোমাটিক জুঁই সুগন্ধি জাতীয় ফুল। তবে জুঁই বা এর পরিবারের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত আমাদের দেশের নার্সারি ব্যবসায়ীরা এর এমন নামকরণ করেছে। আমাদের দেশে বনে জঙ্গলে অ্যারোমাটিক জুঁইয়ের দেখা পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজন একে  ‘ছগলবটি’ নামে ডাকে। এটি লতানো উদ্ভিদ। তাই কিছু আঁকড়ে ধরতে পারলে বেড়ে উঠতে থাকে। গাছ ভরে ছোট ছোট সাদা ফুল ফুটে। ফুল ফোটা অবস্থায় অসাধারণ সুগন্ধে মাতোয়ারা করে চারপাশ। অ্যারোমাটিক জুঁই ফুলের পাপড়ি বলতে আমরা যা বুঝি তা আসলে ফুলের পাপড়ি নয়, এগুলো ফুলের বৃতি।

টবে অ্যারোমাটিক জুঁই

৬-৮ ইঞ্চির টব অ্যারোমাটিক জুঁইয়ের জন্য ভালো। গাছটি প্রতিস্থাপন করার পর বাঁশের খুটি ব্যবহার করুন। গাছটি খুটিকে অবলম্বন করে বেড়ে উঠবে। দিনে ৬ ঘন্টা সূর্যের আলো পেলে গাছটি ভালো থাকে।

অধিক চারা উৎপাদন 

বংশবিস্তারের জন্য এর কাটিং ব্যবহার করুন। কাটিং তৈরি করতে গাছের অগ্রভাগে কচি ডাল কেটে নিতে হবে৷ যেদিকে পাতা হয়েছে এমন জায়গার উপরে ১ ইঞ্চি করে কেটে নিন। দুদিকের ডাল থেকে একটি ডাল নির্বাচন করে পাশের ডালটি কাটুন। নির্বাচিত ডালটির নিচের দুপাশে ১ ইঞ্চি করে জায়গা রাখুন। তাছাড়া উপরের ডালগুলোও বাছাই করতে পারেন। এবার মোটা বালিতে বা ককোপিটে ডালগুলো বসিয়ে ১ মাস পর নতুন চারাগাছ তৈরি করতে পারেন।

ম্যান্ডেভিলা বর্ষার অতিথি 

বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনিরি ম্যান্ডেভিলের নামানুসারে ম্যান্ডেভিলার নামকরণ করা হয়েছে। সারা বিশ্বের ট্রপিকাল এলাকায় অর্থাৎ গরমও বেশি হয় আবার প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এমন এলাকায় এই গাছ বেশি জন্মে। এর প্রায় ২০০ টি প্রজাতি রয়েছে। তবে আমাদের দেশে ৭-৮ প্রজাতি দেখা যায়। ম্যান্ডেভিলা লতানো গাছ। সাদা, হলুদ, লাল ছাড়াও বিভিন্ন বাহারি রঙের ফুল ফোটে। তবে সাদা ম্যান্ডেভিলা আমাদের দেশে বেশি জনপ্রিয়।

ম্যান্ডেভিলার রোপণ ও পরিচর্যা  

১০-১৪ ইঞ্চির বড় আকারের টব ম্যান্ডেভিলার জন্য ভালো। যেহেতু এটি লতানো উদ্ভিদ এবং এর চারপাশে সাপোর্ট প্রয়োজন তাই একটু বড় আকারের টব নির্বাচন করাই ভালো। তাছাড়া ১০ ইঞ্চির নিচে টব নির্বাচন করলে গাছের ভালো বৃদ্ধি হবে না ও পর্যাপ্ত ফুল পাওয়া যাবে না।

এদের ফুল ফুটতে সূর্যালোক প্রয়োজন হয়। তাই সুর্যের আলোতে গাছটি রাখার চেষ্টা করুন। গাছের কাটিং এর মাধ্যমে ম্যান্ডেভিলার বংশবিস্তার করা যায়৷

বর্ষার রানী বেগম বাহার

বেগম বাহার একধরণের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এর আরেক নাম ‘টিবু চায়না’ তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ একে ‘দাঁতরাঙ্গা’ নামেই চিনে। এর আদি বাসস্থান ব্রাজিলে। আমাদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বা উঁচু এলাকায় এই গাছ বেশি জন্মে। এতে বেগুনি রঙের মাঝারি আকৃতির ফুল ফুটে। বেগম বাহার উচ্চতায় ১৫-২০ ফুট পর্যন্ত হয়। ফুল ফোটা শুরু করলে গাছ বেগুনি ফুলে ছেয়ে যায়। এটি আসলে বুনো ফুল। কথিত আছে- নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রিয় ফুল ছিল এটি। ‘বেগম বাহার’ নামকরণটি তিনিই করেন। ফুলের পাশাপাশি এতে ফল হয়। যেটি মূলত গাছের বীজ।

বেগম বাহারের পরিচর্যা ও গুণাবলী  

৬-৮ ইঞ্চির টবে এই গাছ প্রতিস্থাপন করা যায়। বেগম বাহারের প্রচুর কুঁড়ি আসে ও ফুল ফুটে তাই এর খাদ্যের চাহিদা বেশি। সঠিক পন্থায় মাটি তৈরি করে অর্গানিক সার ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় গাছটি সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে না, আশানুরূপ ফুলও পাওয়া যাবে না।

পরিপূর্ণ সূর্যের আলোয় গাছটিকে রাখতে চেষ্টা করবেন। ছায়াযুক্ত স্থান পরিহার করুন। ছায়াতে রাখলে গাছটি সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে না। বাড়ির ছাদ বা বারান্দা যেখানেই রাখুন সেখানে যাতে পরিপূর্ণ সূর্যের আলো পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বেগম বাহারের রয়েছে কিছু ভেষজ গুণ। জোকের কামড়ে রক্তক্ষরণ কমাতে এটি ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয়, বাতের ব্যথা, বাত জ্বরে এর পাতার রস বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

বর্ষায় থোকা থোকা ফুল দেবে হাজারি বেলি

হাজারি বেলি যার অন্যনাম ‘চাইনিজ বোয়ার’ বা ‘ওয়াইল্ড জেসমিন’। এটি বহুবর্ষজীবী গুল্ম প্রজাতির উদ্ভিদ। হাজারি বেলি ৪-৬ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। গাছে অজস্র সাদা ফুল ফুটে। ফুলগুলো মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত। দেখতে গোলাপের মতো। গাছে থোকায় থোকায় ফোটে। বেলির জাতের সাথে এর কোনো সাদৃশ্য নেই। বর্ষার পানি পেলেই শিকড় থেকে এর ফুল আসতে শুরু করে৷ গাছটি একটি চিরসবুজ গাছ। পাতাগুলো অনেকটা পান পাতার মতো। এর ফুলগুলো মালা ও গাজরা তৈরিতে ব্যবহার হয়। বিশ্বের অনেক দেশে এর চাষ হলেও আমাদের দেশে শুধু কিছু সৌখিন মানুষ এর কদর করে থাকেন। প্রতিটি থোকায় ৫০ এর অধিক ফুল ফোটে ও প্রস্ফুটিত ফুলগুলো তিনদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ফুলগুলো পর্যায়ক্রমে ফুটে তাই একটি থোকা হতে মাসখানেক ফুল ও সৌরভ পাওয়া যায়। 

হাজারি বেলির টব নির্বাচন ও পরিচর্যা 

৮-১০ ইঞ্চি টব নির্বাচন করবেন। হাজারি বেলি সাধারণ বেলি থেকে বড় হয়। তাই বড় আকারের টব নির্বাচন করাই ভালো। হাজারি বেলি দ্রুত বর্ধনশীল। প্রতিকূল পরিবেশে এরা খুব ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারে৷ 

ছায়াতে এই গাছ ভালো হয় না। বাগানের সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে এমন জায়গায় এই গাছ রাখতে হবে। গাছের গোড়ার মাটি যাতে শুকিয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ও নিয়মিত পানি দিতে হবে। তাছাড়া মাঝেমধ্যে অর্গানিক সার ব্যবহার করলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। 

বর্ষার দরকারী ফুল করবী

করবী একটি চিরহরিৎ জাতীয় উদ্ভিদ। ঝোপা জাতীয় এই গাছে প্রচুর ফুল ফুটে। সাদা, লাল ও গোলাপি তিনটি ভ্যারিয়েন্টে এই ফুল ফুটে। করবীর আদি বাসস্থান দক্ষিণ আমেরিকা ও ওয়েন্ট ইন্ডিজ অবার অনেকের ধারণা এটি ভারতীয় উপমহাদেশের ফুল। এ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এই ফুল দেখা যায়। করবীর পাতা সরু ও লম্বাটে। শাখা প্রশাখার অগ্রভাগে ফুল ফুটে৷ করবী উচ্চতায় ৫-৯ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

কবরীর টব বাছাই ও মাটি প্রস্তুতকরণ 

১০-১২ ইঞ্চি টবে এর চারা প্রতিস্থাপন করা যায়। তবে ছোট চারার জন্য প্রথম দিকে ছোট আকারের টব নির্বাচন করা যেতে পারে। পর্যক্রমে বড় আকারের টবে পুনরায় প্রতিস্থাপন করা যায়৷ করবী গাছের জন্য বেলে দোআঁশ মাটি উপযুক্ত। কলম বা বীজের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার করা যায়।

করবী গাছের রয়েছে অসাধারণ ভেষজ গুনাবলী। অকালে চুল পাকা, চোখের রোগে, বিছা বা ভিমরুলের কামড়ে, বিভিন্ন চর্মরোগ, গর্ভপাত করাতে ও সিফিলিস রোগে এর পাতা ও শিকড় ব্যবহার করা হয়। 

সতর্কতা 

করবীর যেমন ভেষজ গুণ আছে ঠিক তেমনি এর কিছু অপকারী দিকও রয়েছে। করবী গাছের পুরোটাই বিষে ভরপুর। শিশু বা ছোট কোনো প্রাণী এর পাতা খেলে মৃত্যু হতে পারে। বাসায় করবী গাছ থাকলে তা শিশু ও গবাদিপশু বা গৃহপালিত প্রাণী থেকে দূরবর্তী স্থানে রাখতে হবে। 

বর্ষাকালে বারান্দা ঝলকানো মর্নিং গ্লোরি ফুল

মর্নি গ্লোরি একধরনের লতানো ফুলগাছ। এটি স্থায়ী গাছ। সারাবছর কমবেশি ফুল ফুটলেও বর্ষায় এই গাছে প্রচুর ফুল আসে৷ এর আদিবাস আমেরিকা ও মেক্সিকো অঞ্চলে। মর্নিং গ্লোরির ১০০০টির মতো প্রজাতি রয়েছে। সাদা, নীল, লাল, বেগুনি ছাড়াও বিভিন্ন রঙের মর্নিং গ্লোরি দেখা যায়। আমাদের দেশে সাদা, নীল, বেগুনি ও আকাশি রঙের মর্নিং গ্লোরি বেশ জনপ্রিয়। সুন্দর ফুলটি দেখতে ফানেল আকৃতির। এর পাতা গোল। অনেকটা ছোটো পান পাতার মতো। মর্নিং গ্লোরি নামের সাথে ফুল ফোটার সাদৃশ্য রয়েছে। ভোরে এর ফুল ফোটে, বিকেলে চুপসে যায়। তাই একে মর্নিং গ্লোরি বলা হয়ে থাকে। 

মর্নিং গ্লোরি ফুলের জন্য টব ও মাটি প্রস্তুত 

৬-৮ ইঞ্চির টবে মর্নিং গ্লোরি রোপণ করা যায়। বীজ থেকে মূলত এরা বংশবিস্তার করে৷ বুনো ফুল হওয়ায় এরা আর্দ্র মাটি পছন্দ করে। তাই মাটি তৈরিতে অবশ্যই ককোপিট ব্যবহার করতে হবে। ককোপিট মাটিতে পানি ধরে রাখে।

মর্নি গ্লোরি দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। এরা সূর্যালোক পছন্দ করে। তবে তীব্র রোদ সহ্য করতে পারে না৷ মর্নি গ্লোরি সেমি সেডের গাছ। তাই সকালে রোদ পায় এমন জায়গায় গাছটি রাখতে হবে। সুন্দর ভাবে বেড়ে উঠার জন্য বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরি করে দিতে হবে। এর ফলে গাছটি মাচা বেয়ে উঠবে ও ঝোপাকৃতি হবে এবং প্রচুর ফুল ফুটবে৷ 

বর্ষায় মন ভালো রাখবে সুগন্ধী মাধবীলতা

মাধবীলতা সুগন্ধি ফুল। এরা বহুবর্ষজীবী লতানো উদ্ভিদ। কয়েক বছর মাধবীলতা গাছ রাখলে এর গোড়া বেশ মোটা ও গাছটি ঝোপাকৃতি হয়। ডাল গুলো নিয়মিত প্রুনিং করলে নতুন ডাল গজায়। ফুল থেকে বীজ হয়। বীজ ছাড়াও ডালের কাটিং দিয়ে এর বংশবিস্তার করা যায়। বর্ষা ছাড়াও গ্রীষ্ম ও বসন্তে এর ফুল ফুটে। ছোটো আকারের বেশকিছু ফুল একত্রে ফুটে। একটি ফুলে পাঁচটি পাপড়ি থাকে। পাতাগুলো সবুজ, লম্বা ও ডিম্বাকৃতি। 

মাধবীলতার চারা রোপণ ও পরিচর্যা

ইনডোর বা ছাদ বাগান উভয় জায়গাতেই মাধবীলতার চারা লাগানো যায়। ১২-১৪ ইঞ্চি টব মাধবীলতার জন্য প্রযোজ্য। এটি খুব দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। এর শিকড় খুব তাড়াতাড়ি মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য ছোট আকারের টব পরিহার করা উচিৎ।

সরাসরি সূর্যালোক অথবা সেমি সেড দুই জায়গাতেই গাছটি ভালো জন্মায়। তবে প্রখর সূর্যতাপের ফলে যদি পাতাগুলো হলুদ হয়ে যায় তবে একে সেমি সেডে রাখতে হবে। হলুদ পাতাগুলো ছেঁটে দেওয়াই ভালো। সেমি সেডের মাঝেও এর পাতা হলুদ হয়ে গেলে অবশ্যই এর খাবারে নজর দিতে হবে। এজন্য ভালো মাইক্রো নিউট্রিয়েন্স স্প্রে করতে হবে৷ 

আপনার ছাদ বা বারান্দায় সীমিত পরিসরে হলেও বর্ষাকালীন কিছু চমৎকার ফুলের চাষ করতে পারেন। প্রকৃতির সান্নিধ্য মানুষের মন ও শরীরকে করে সতেজ। আর ঋতুভেদে মানুষের মনের অবস্থাও হয় ভিন্ন ভিন্ন। এমন শহুরে বাস্তবতায় বারান্দা বা ছাদের এক চিলতে জায়গায় কিছু ফুল আপনার অনুভূতিকে নাড়িয়ে দিয়ে যেতে পারে দারুণভাবে।

বর্ষাকালীন ফুলের জন্য আদর্শ ড্রেনেজ সিস্টেম ও মাটি তৈরি 

প্রায়ই দেখা যায় আপনার বাগানের গাছগুলোর কাঙ্ক্ষিত বৃদ্ধি ঘটছে না। সেক্ষেত্রে আপনার হতাশ হওয়া ছাড়া কি-ই-বা করণীয় আছে। কিন্তু হতাশ না হয়ে আপনার উচিৎ যথার্থ কারণ খুঁজে বের করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া। অনেকের গাছ অল্পতেই রোগাক্রান্ত হয় এমনকি মারা যায়। এর অন্যতম কারণ ভালো ড্রেনেজ সিস্টেম না থাকা ও ভুল পন্থায় মাটি তৈরি করা।

গ্রামীণ পরিবেশে আপনার বাগানের পানি নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা রাখা যেমন জরুরী তেমনি টবে গাছ চাষ করার ক্ষেত্রেও পানি নিষ্কাশন গুরুত্বপূর্ণ।  বর্ষাকালীন ফুলগুলোর মধ্যে আপনি যে ফুলগাছ যে স্থানে চাষ করবেন সে অনুযায়ী ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রাখতে হবে। 

ড্রেনেজ সিস্টেম

ড্রেনেজ সিস্টেম বলতে বুঝায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা। টবে গাছ প্রতিস্থাপনের পূর্বে অবশ্যই পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে। গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে খুব সহজেই গাছটি মরে যাবে। 

প্রায় সব টবের নিচে ছিদ্র থাকে। টবের আকার ও গাছের পানি ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী একাধিক ছিদ্র করা যেতে পারে। এবারে ভাঙা টবের অংশ দিয়ে ছিদ্রটি ঢেকে দেবেন। এরপর পাথরের ছোট টুকরো নিয়ে একটি স্তর করতে হবে। এমন ভাবে পাথরগুলো ছড়িয়ে দেবেন যেন মাটির ভাঙা টুকরো দেখা না যায়।

এবারে মাটি তৈরিতে যে লাল মোটা বালি ব্যবহার করা হয় সেটি দিয়ে আরো একটি স্তর তৈরি করে নেবেন। এভাবে টব তৈরি করলে টবের হোল বা ছিদ্র বন্ধ হবে না ও অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যাবে। যেকোনো গাছ প্রতিস্থাপনের জন্য টবে মাটি দেওয়ার আগে অবশ্যই এই ধাপ অবলম্বন করুন।

মাটি তৈরি

এখন ৮ ইঞ্চি মাপের ২টি টবের মাটি প্রস্তুত নিয়ে আলোচনা করবো। এই সাধারণ অনুপাতে আপনারা বাগানের ফুলগাছের জন্য মাটি তৈরি করতে পারবেন।

নির্বাচিত মাটিকে প্রথমে আলগা ও ঝুরঝুরে করে নিন। যাতে মাটিতে কোনো দলা না থাকে। ঝুরঝুরে মাটিতে সহজেই সার ও খাদ্য মিশে যায়। বালি চালার চালনি দিয়ে মাটিকে চেলে নিতে পারেন। ২টি টবের মাটি প্রস্তুত করতে দুই টব পরিমাণ গার্ডেন সয়েল নেবেন। এবারে এতে এক বছরের পুরনো গোবর সার ৫০০ গ্রাম, নদীর সাদা বালি ৫০০ গ্রাম, ভার্মি কম্পোস্ট ৫০০ গ্রাম, ২ চা চামচ সুপার ফসফেট, ৪ চা চামচ হাড়ের গুড়া, ৪ চা চামচ নিম খৈল, ২ চা চামচ শিং কুচি, ৪ চা চামচ সরিষার খৈল, ৪ চা চামচ কাঠের ছাই ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। 

এবারে ড্রেনেজ করা টবে মাটি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত চারাটি রোপণ করুন। চারা কিনে আনার পরপরই একে টবে প্রতিস্থাপন করবেন না। একটু সময় নিন, আপনার বাড়ির পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে দিন। প্রয়োজনে কয়েকদিন সেডে রাখুন। এরপর চারাগুলো প্রতিস্থাপন করুন। 

এভাবে মাটি তৈরি করে চারা রোপণ করলে আর নিয়মিত খাদ্য ও সেচ দিলে আপনি অবশ্যই আশানুরূপ ফল পাবেন। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *