তানিয়া মুক্তা ঢাকায় বসবাসকারী একজন গৃহিনী ও উদ্যোক্তা। ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি তীব্র ভালোবাসা তাকে ছাদ বাগানে আগ্রহী করে তোলে। ব্যস্ত ঢাকার বাসার ছাদে শুরু হয় সে কর্মযজ্ঞ। তিলে তিলে গড়ে ওঠে তার বিশাল বাগান। তার নিতান্ত শখের বাগান আজ সমৃদ্ধ এক মহা কানন। পরবর্তীতে তিনি “তানিয়া বাগান বিলাস” নামক ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে গাছ বিক্রি করে সামাজিক উদ্যোক্তা (সোশ্যাল আ্যন্ট্রাপ্রেনার) হিসেবে সকলের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন।
সম্প্রতি বাগান, ছাদ বাগান, বাগানের পরিচর্যা ও ইনডোর প্লান্ট নিয়ে কথা হয় আদিপ্রাণের সাথে। কথা প্রসঙ্গে তানিয়া বাগান করার নানাবিধ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমাদের জানান। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন আদিপ্রাণের কনটেন্ট ম্যানেজার আশরাফ আল যায়েদ।
আদিপ্রাণ: বাগান করার জার্নিটা কবে থেকে শুরু?
তানিয়া: একদম ছোট থেকেই টুকটাক গাছ লাগানো আমার পছন্দ। বলতে পারেন এটা আমার একধরনের গভীর ভালো লাগা ও ভালোবাসার বিষয়।
আদিপ্রাণ: বাগান করার শুরুর দিকে কোনও ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন কি?
তানিয়া: বাগানি হিসবে যাত্রার প্রথমদিকে গাছের যত্ন সম্পর্কে তেমন জানতাম না। কোন গাছে কী পরিমাণ পানি বা খাদ্য দিতে হবে তা সম্পর্কেও জানাশোনা ছিলো কম। তাই কোথাও বেড়াতে গেলে অধিকাংশ গাছ অযত্নে মরে যেতো। আবার গাছের আশানুরূপ বৃদ্ধিও হতো না অনেক সময়।
আদিপ্রাণ: আপনার বাগানে কত ধরনের কি কি গাছ রয়েছে?
তানিয়া: আমার বাগানে প্রায় সব রকম গাছই রয়েছে। বিভিন্ন ইনডোর প্লান্ট, ক্যাকটাস, ফুল, ফল, ভেষজ ইত্যাদি। আমি চেষ্টা করি বাগানে গাছের বৈচিত্র্য তৈরি করতে। এটা আমাকে বহু অজানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে।
আদিপ্রাণ: বাগানের যত্নে প্রতিদিন কতটুকু সময় দিতে হয়?
তানিয়া: তেমন ধরাবাঁধা কোনোকিছু নেই। যখন যেমন সময় পাই তখন ততটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করি। আসলে আমার অবসর সময়ের পুরোটা বাগানে কাটাই। কখনো ১০ মিনিট আবার কখনো কয়েক ঘণ্টা। এটা নির্ভর করে মনের অবস্থার ওপর। আর বাগানের গাছগুলোর সাথে কতোটা গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে তার ওপর।
আদিপ্রাণ: আমরা যতটুকু জানি আপনার স্বামী ও সন্তানসহ আপনার সুখী পরিবার। পরিবারকে কখনো আপনার বাগানের জন্য প্রতিবন্ধকতা মনে হয়েছে কি?
তানিয়া: আমার কাছে কখনো এমন মনে হয়নি। বরং সংসার ও বাচ্চাদের সামলিয়ে আমার নিজের জন্য যতটুকু সময় থাকে, সেই সময়টা আমি বাগানে কাটাই। আমার ফ্যামিলি বাগানের ব্যাপারে আমাকে যথেষ্ট সাপোর্ট করে। বাগানের গাছগুলোকে খুব আপন মনে হয়। ছোট্ট চারাগাছের পল্লব, ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা, এসব পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যের একটি। এসবের সাথে আমার বাচ্চারাও বেশ মিশে যেতে পারে। তাদের কাছেও বাগানের গাছগুলো আনন্দের খোরাক।
আদিপ্রাণ: ছাদ বাগান অথবা ইনডোর প্লান্ট- কোনটির পরিচর্যা সহজ বলে আপনি মনে করেন?
তানিয়া: ছাদ বাগানের গাছের তুলনায় ইনডোর প্লান্টের যত্ন আমার কাছে খুব সহজ মনে হয়। এখানে একটা ব্যাপার আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ছাদ বাগান করার মতো যাদের পর্যাপ্ত স্থান রয়েছে তারা ইনডোর প্লান্টের পরিসর থেকে ছাদ বাগানে যেতে পারেন। আসলে গাছের প্রতি আপনার ভালো লাগা তৈরি হয়ে গেলে সেটার যত্ন নেয়া কখনো বিরক্তিকর বা ভারী কোনো কাজ মনে হবে না। আর আপনার যদি তেমন সময় ও স্থান সংকুলান না থাকে তাহলে ইনডোর প্লান্টেই সীমিত থাকতে পারেন।
আদিপ্রাণ: সাকুলেন্ট বা ক্যাকটাস এর বিশেষ পরিচর্যায় আপনি কী করেন?
তানিয়া: সাকুলেন্ট মিডিয়া ও ক্যাকটাস মিডিয়াতে রোপন করি। তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। প্রতি বছর গাছটি এক টব থেকে আরেক টবে স্থানান্তর করে দিই। নতুন করে গাছের জন্য মিডিয়া তৈরি করি ও সাকুলেন্ট, ক্যাকটাস ফাঙ্গিসাইড (গাছের ছত্রাক নিরোধক) দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে আবার লাগিয়ে দিই।
আদিপ্রাণ: মিডিয়াতে রোপন করা সম্পর্কে বললেন। এটি কি?
তানিয়া: মিডিয়া বলতে বোঝানো হচ্ছে লালবালু, হাড়ের গুড়া, জৈব সার মিশিয়ে তৈরি করা মিশ্রণটি। সাকুলেন্ট এর সাথে কোকপিট যোগ করতে হয়। এই প্রসেসটাই মিডিয়া।
আদিপ্রাণ: ফুল, ফল নাকি ভেষজ উদ্ভিদ কোনটি বাগানে বেশি রোপণ করা ভালো?
তানিয়া: একজন বাগানি হিসেবে আমার মনে হয় একটি বাগানে সব ধরনের গাছ থাকা উচিত। কারণ কিছু গাছ আপনার মনের খোরাক যোগাবে আবার কিছু যোগাবে প্রাথমিক চিকিৎসার রসদ। যেমন বলা যায় গোলাপ বা জবা আপনার মনের খোরাক যোগাতে সক্ষম। আবার তুলসী গাছ প্রাথমিক চিকিৎসার উপকরণ হিসেবে প্রসিদ্ধ। শুষ্ক কাশি অনুভূত হলে আপনি দুটো তুলসী পাতা তুলে চা খেতে পারেন। যা আপনার শুষ্ক কাশি উপশম করবে।
আদিপ্রাণ: কোন ধরনের গাছ সহজে রোগাক্রান্ত হয় ও রোগাক্রান্ত গাছগুলোর জন্য প্রাথমিকভাবে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়?
তানিয়া: যেকোনো বিদেশী গাছে রোগ বালাই বেশি হয়। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানোর একটি ব্যাপার তো থাকেই। এছাড়া বিভিন্ন রোগের জন্য আলাদা আলাদা পদক্ষেপ নিতে হয়। সব গাছের রোগবালাই এক রকম হয় না। আর প্রতিকার ও যত্নও এক রকম হয় না। সম্ভব হলে রোগাক্রান্ত গাছটিকে বাগান থেকে আলাদা করে নিয়ে (কোয়ারেন্টাইন) পরিচর্যা করা উচিত।
আদিপ্রাণ: বাগানে কোন ধরনের সার ব্যবহার করেন?
তানিয়া: আমার বাগানে দেশীয় প্রজাতির গাছ বেশি। এগুলো সাধারণত জৈব সারে ভালো বৃদ্ধি পায়। খুব বেশি জরুরী না হলে আমি বাগানে রাসায়নিক সার ব্যবহার করি না। প্রথম দিকে আমি সবজি পচিয়ে কম্পোস্ট তৈরি করে ব্যবহার করতাম। এখন কম্পোস্ট এর পাশাপাশি গোবর সার ব্যবহার করি। এতেকরে মাটির উর্বরতা শক্তি বজায় থাকে। গাছের বৃদ্ধিও ভালো হয়।
আদিপ্রাণ: প্রিয় মানুষকে উপহার দেওয়া যায় এমন কিছু গাছের নাম বলুন।
তানিয়া: গাছ তো বিভিন্ন রকমের হয়। আপনার প্রিয় মানুষ কোন ধরনের গাছ পছন্দ তার উপর নির্ভর করে আপনি তাকে গাছ উপহার দিতে পারেন।
আদিপ্রাণ: আপনার বাগানের প্রিয় গাছ কোনটি? গাছ নিয়ে কোনো স্মৃতি থাকলে আমাদের বলুন।
তানিয়া: আমার বাগানের সব গাছই প্রিয়। নির্দিষ্ট করে কোনো গাছের নাম বলা সম্ভব নয়। আমার বিয়ের পর, এখনকার সময় থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে হাজব্যান্ড আমাকে বিভিন্ন নার্সারি এবং বৃক্ষ মেলায় নিয়ে নানারকম গাছ কিনে দিতো। তখন বৃক্ষ মেলায় খুব কম সংখ্যক মানুষের আনাগোনা ছিল। সেগুলো এখন আমার কাছে স্মৃতি। কারণ বাচ্চাদের স্কুল, পড়াশোনার জন্য এখন আর তেমনভাবে বাইরে যাওয়া হয়ে ওঠে না।
আদিপ্রাণ: নতুন বাগানিদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
তানিয়া: যারা নতুন তাদেরকে আমি বলবো প্রথমেই দামি দামি গাছ কিনে বাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করার কোনো দরকার নেই। দেশি গাছ কিনুন। গাছের যত্ন সম্পর্কে জানুন। তারপর আস্তে আস্তে আপনার সংগ্রহে বৈচিত্র্য আনুন। শুরুতে দু’একটি গাছ মরে গেলেও হতাশ হবেন না। হাল ছাড়বেন না। সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারলে আপনার বাগানের সবগুলো গাছই থাকবে প্রাণবন্ত।
আদিপ্রাণ: মূল্যবান সময় ও অভিমত দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ৷
তানিয়া: আদিপ্রাণকেও ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর সাক্ষাৎকার