নাগরিক জীবনের চারপাশে শুধু দালানকোঠা। মন চায় সবুজের প্রশান্তি। আর চাইলেই এই প্রশান্তি আপনি ঘরের মধ্যেই পেতে পারেন। এর জন্য রয়েছে ইনডোর প্লান্ট। আপনার ঘরকে নান্দনিক রূপে উপস্থাপন করতে এর জুড়ি নেই।
আপনার ঘরের সাজসজ্জা ও আলোর ওপর ভিত্তি করে গাছ নির্বাচন করুন। আপনার ফার্নিচার এর সাথে সাদৃশ্য রেখে টব রাখতে পারেন। যারা ইনডোর প্ল্যান্ট আগে ব্যবহার করেন নাই, তাদের জন্য পরিচর্যার কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরি। খুব সহজ কয়েকটি বিষয় মনে রাখলে গাছগুলো সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে।
আলোর পর্যাপ্ত ব্যবহার
ইনডোরে যেহেতু গাছগুলো বেড়ে উঠে সুতরাং অধিকাংশ গাছে খুব বেশি সূর্যের আলো লাগে না। এমনকি সরাসরি সূর্যের আলোয় রাখলে গাছগুলো নেতিয়ে মরে যেতে পারে। শুরু থেকে কোনো গাছকে কম আলোয় রাখলে সে অধিক সূর্যতাপ সহ্য করতে পারে না। তাই গাছের স্থান পরিবর্তন করতে সতর্কতা অবলম্বন করুন। কম আলো থেকে হুট করে বেশি আলোতে আনতে গেলে একটু একটু করে আলোর কাছে আনবেন, এই কাজে কয়েকদিন সময় নেবেন। গাছের জন্য এমন জায়গা নির্বাচন করবেন যেখানে অন্তত সূর্যের আলোটুকু পায়। ফন্টোসিন্থেসিসের মাধ্যমে গাছ খাদ্য তৈরি করে আর এর জন্য প্রয়োজন সূর্যালোক। গাছের বৃদ্ধিতে এর সম্পর্ক রয়েছে। ইনডোর প্লান্টকে সরাসরি সূর্যের তাপে রাখবেন না। আপনার গাছের জন্য (ফুল ও পাতা) ১২-১৬ ঘণ্টা অলোর প্রয়োজন। বেশকিছু ইনডোর প্লান্ট ঘরের লাইটের ইলোকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনকে সূর্যের আলোর বিপরীতে ব্যবহার করে। তাই ঘরের লাইট আপনার গাছগুলোর জন্য বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়ক।
মাটির আদ্রতা
কয়েকদিন পরপর টবের মাটির অবস্থা পরখ করুন। মাটির আদ্রতা কমে গেলে পরিমিত পানি ঢালুন। গাছের গোড়ায় পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। এতে মশার উপদ্রব হতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে গাছের পাতার রঙ পরিবর্তন হলে, পাতার বৃদ্ধি ব্যহত হলে, পাতা ঝরে গেলে বা পাতার গোড়া নরম হয়ে ঝরে যেতে থাকলে বুঝতে হবে গাছ পানিশূন্যতায় আছে, প্রয়োজনীয় পানি ঢালতে হবে। অন্যদিকে পাতার নিচে হলুদ রঙ হলে,পাতার বৃদ্ধি কমে গেলে, পাতা কুকড়িয়ে আসলে বুঝতে হবে পানির মাত্রা বেশি হয়েছে। এখানে মাত্রা অনুযায়ী পানি দিতে হবে। গরম পানি গাছের জন্য ক্ষতিকারক তাই গাছের জন্য রুমের তাপমাত্রা অনুযায়ী পানি ব্যবহার করতে হবে। পানির তাপমাত্রা তারতম্য হলে গাছে শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমনকি আপনার সাধের গাছটি মারাও যেতে পারে।
ক্যাকটাস বা সাকুলেন্ট ঘরে রাখতে চাইলে তাদের জন্য শুকনো বালি ও পাথর ব্যবহার করুন৷ এদের বেশি পানি দেওয়া যাবে না। টবের নিচে ছিদ্র রাখুন। অতিরিক্ত পানি এসব গাছের মৃত্যুর কারণ। এরা অধিক সূর্যতাপ সহ্য করতে পারে আবার ঠাণ্ডা স্থানেও থাকতে পারে। ক্যাকটাস গাছে বেশি পানি দিলে পাতা শুকিয়ে আসে এবং ফাংগাল ইনফেকশন হয়, শেষমেশ গাছটি মারা যায়। পাতার উপর মাকড়সার জালের মতো হলে বুঝতে হবে স্পাইডার মাইটস হয়েছে। এমতাবস্থায় এই জালকে সুন্দর করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
ঘরের আদ্রতায় বিশেষ নজরদারি
গাছের পাতা কুড়ি শুকিয়ে বাদামি রঙের হলে বুঝতে হবে গাছের আদ্রতার অভাব। গাছগুলোর স্বাভাবিক বিকাশে ঘরকে আদ্র রাখতে হবে। শুষ্ক বায়ু গাছের বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় বাধা। হিউমিডিফায়ার ঘরকে ঠাণ্ডা ও আদ্র রাখে। যাদের ঘর শুষ্ক তারা এটা ব্যবহার করতে পারেন। হিউমিডিফায়ার কেনা সম্ভব না হলে একটা ট্রেতে নুড়িপাথর ভিজিয়ে রেখে তা গাছের কাছে রেখে দেবেন এতে গাছগুলো আদ্র হবে তাছাড়া রুমের আদ্রতা বজায় থাকবে। তাছাড়া প্রতিদিন গাছে স্প্রে করতে পারেন এতে গাছ সতেজ থাকবে।
স্থান পরিবর্তনে সতর্কতা
ঘনঘন গাছের স্থান পরিবর্তন করা যাবে না। গাছকে একটা পরিবেশে মানিয়ে নিতে বেশ ক’দিন সময় লাগে। হুটকরে বেশি আলো কিংবা বেশি অলো থেকে অল্প আলোয় নেওয়া যাবে না। এতে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। স্থান পরিবর্তন করতে সময় নিন। শুরুর দিকে একঘণ্টা সময় নিয়ে নতুন জায়গায় রেখে আসুন আস্তে আস্তে সময় বাড়ান। স্থান পরিবর্তন এর প্রয়োজন হলে এভাবেই ধীরে ধীরে আপনার গাছকে অগ্রসর করতে হবে।
সার প্রয়োগ
গাছের মাটি প্রস্তুতের সময় এতে অবশ্যই সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছ লাগানোর সময় আপনাকে অবশ্যই ১০-১০-১০ অনুপাতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম দিতে হবে। পটাসিয়াম অধিক ফুল হতে, নাইট্রোজেন পাতার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। গাছ লাগানোর পর প্রতি মাসে একবার জৈব সার ব্যবহার করুন। ব্যবহৃত টি-ব্যাগ, ডিমের খোসার গুড়া জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করুন। বাসায় তৈরি এসব জৈবসার গাছের জন্য উপকারি।
নিয়মিত গাছ ছাঁটা বা পরিষ্কার
গাছে শুকনো পাতা হলে বা পাতা বাদামি হলে সেটা কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলুন। গাছের পুষ্টি সব অংশ দিয়ে বাদামি বা মরা অংশটুকু বাঁচাতে সাহায্য করবে, ফলে গাছের বাকী অংশ পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হবে। তাছাড়া গাছ অতিরিক্ত বড় হলে বা ঝোপ হলে সেটা পরিমানমতো কেটে ফেলতে হবে। যাতে পুরো গাছ সহজে পুষ্টি পায়। গাছ নিয়মিত ছাঁটলে এর বৃদ্ধি দ্রুত হয়।
পাতার যত্ন
গাছে শুধু সার, পানি দিলেই এর যত্ন শেষ হয় না। গাছের পাতায় ধুলা জমলে তা সুতি নরম কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এতে গাছের ময়েশ্চার ঠিক থাকে। দেখতেও সুন্দর লাগে। পাতার মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে যা দিয়ে গাছ অক্সিজেন ছাড়ে আর কার্বনডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে, পাতায় অতিরিক্ত ধুলার প্রলেপ থাকলে তা ব্যহত হয়। অন্যদিকে পাতা পরিষ্কার থাকলে গাছে সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
পোকার আক্রমণে করনীয়
ইনডোর প্লান্ট এর অন্যতম সমস্যা হচ্ছে পোকার আক্রমণ। ঘরের গাছকে পোকা আক্রমণ করার আগেই নিতে হবে কিছু পদক্ষেপ। আর যেহেতু তা একেবারে আপনার ঘরের ভিতরে সেজন্য অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিই আপনার জন্য বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে আপনি নিমের তেল, এন্টি-ইন্সেক্টিসাইড সাবান, ফ্লাই লাইট, স্টিকি বোর্ড, সেক্স ফেরোমেন ট্র্যাপ ইত্যাদি যে কোন একটা পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন। মিলিবাগের মতো ছোটো পোকারা আক্রমণ করলে ঔষধালয় থেকে অ্যালকোহল এনে কটন বল বা কাপড়ে এনে গাছের আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে দিলে খুব সহজেই পোকা দূর হয়ে যাবে।
ইনডোরে গাছগুলোর একটু বেশি যত্ন প্রয়োজন হয়।আপনার ঘরের বাতাসকে বিশুদ্ধ করার পাশাপাশি ঘরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে কয়েকগুণ। সব মিলিয়ে বাঁচবে সবুজ এই নাগরিক জীবনে, বাঁচবে সবুজ জীবনের গহীনে।