ঘরে রাখুন পরিবেশবান্ধব স্পাইডার প্লান্ট

মার্ভেলের কল্যাণে আমরা সবাই কমবেশি স্পাইডার ম্যান তথা মাকড়সা মানবের সাথে পরিচিত। পরিবেশবান্ধব সেই স্পাইডার ম্যানের মতোই স্পাইডার প্লান্ট আপনার ঘরের শোভা বাড়াতে ও পরিবেশকে স্বাস্থ্যকর রাখতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। রিডিং ডেস্ক কিংবা, বারান্দার এক কোণায় রাখতে পারেন গাছটি। স্পাইডার প্লান্ট সব জায়গায় তার সুন্দর সবুজ পাতা দিয়ে মুগ্ধতা ছড়াতে সক্ষম। এজন্যই হয়তো এটা সারাবিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইনডোর গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম।

স্পাইডার প্লান্ট Asparagaceae  গোত্রের একটি ট্রপিকাল গাছ। এর আদি বাসস্থান আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে। বৈজ্ঞানিক নাম  Chlorophytum comosum । গাছটির সুদৃশ্য চিকন সবুজ পাতা ভ্যারাইটি ভেদে প্রায় বারো থেকে আঠারো ইঞ্চি পর্যন্ত  লম্বা হয়। মাটির নিচে গাছটির সাদা এবং রসালো বাল্ব আছে। বসন্তে গাছটিতে ছোট্ট সাদা ফুল ফোটে। ক্ষণস্থায়ী এই ফুল যেন নববধূর নতুন নাক ফুল। উপযুক্ত পরিবেশে গাছটি বছরের পর বছর বাঁচতে পারে।

বসন্তে গাছ থেকে লম্বা স্পাইক বের হয় যা দেখতে ঠিক মাকড়সার পায়ের মতো। এজন্যই এই গাছের নামকরণ করা হয়েছে স্পাইডার প্লান্ট। একে স্পাইডার আইভি, রিবন প্লান্ট ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।

এখন পর্যন্ত স্পাইডার প্লান্টের ২০০ এর মতন ভ্যারাইটি পাওয়া গেছে যার মধ্যে মাত্র কয়েকটি ইনডোর গাছ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে কমন স্পাইডার প্লান্টগুলোর মধ্যে ভেরিগেটেড স্পাইডার প্লান্ট, বনি (কার্লি) স্পাইডার প্লান্ট, গ্রিন স্পাইডার প্লান্ট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

স্পাইডার প্লান্ট রোপন ও সতর্কতা

স্পাইডার প্লান্ট খুবই কম যত্নে বেড়ে উঠতে পারে। আলো, পানি ও সারের সঠিক প্রয়োগে গাছ ঝলমলিয়ে ওঠে এবং অসংখ্য ছোট চারার জন্ম দেয়। শহুরে ঝুলবারান্দা কিংবা ঘরের শোভা বৃদ্ধির জন্য স্পাইডার প্লান্টের বেশ কদর রয়েছে। গাছটিকে বিভিন্ন সাইজের ঝুলন্ত টবে বেশ মানানসই দেখায়। ডেস্ক বা যেকোনো সমতলের ওপর রাখার ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে যেন এর লম্বা পাতা এবং স্পাইক কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

স্পাইডার প্লান্টের প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান

স্পাইডার প্লান্ট আলো-ছায়ার মধ্যে থাকতে ভালোবাসে যা তার নেটিভ ট্রপিক্যাল পরিবেশেরে একটা বৈশিষ্ট্য। তবে এটি কড়া রোদ সহ্য করতে  পারে না। বিশেষ করে দুপুরের কড়া রোদ গাছের পাতা পুড়িয়ে ফেলে। গাছকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যেন  তা দুই-এক ঘণ্টা সকাল বা বিকালের মিষ্টি রোদ পায় এবং ভরদুপুরের রোদ থেকে নিরাপদ থাকতে পারে।

যদি স্পাইডার প্লান্টকে দক্ষিণ বা পশ্চিমমুখী জায়গায় রাখতে হয় তাহলে এভাবে রাখবেন যেন তা ফিল্টার্ড আলো পায়, অর্থাৎ সূর্যের আলো আর গাছের মাঝে কাঁচ বা স্বচ্ছ কিছু রাখবেন যাতে আলোর তীব্রতা কমে আসে। স্পাইডার প্লান্ট কম আলোতেও বাঁচে কিন্তু সেক্ষেত্রে গাছের বৃদ্ধি,  সতেজতা কমে আসে এবং পাতাগুলো ঝুলে পড়ে। যাদের ঘরে আলো সেভাবে আসে না, তারা সপ্তাহে দুই-একদিন গাছকে বের করে আলোময় কোনো জায়গায় রাখতে পারেন। 

স্পাইডার প্লান্টের জন্য মাটি তৈরি

স্পাইডার প্লান্ট ঝুরঝুরে মাটি পছন্দ করে যেটা দিয়ে অতিরিক্ত পানি সহজেই বের হয়ে যেতে পারে। ৩০% বেলেদোয়াশ মাটি, ৩০% ককোপিট, ২০% মোটা লাল বালু এবং ২০% গোবর সার বা ভার্মি কম্পোস্ট দিয়ে মাটি প্রস্তুত করতে পারেন। অথবা উপলব্ধ উপাদানের ভিত্তিতে মাটি তৈরি করে  নিতে পারেন। যেভাবেই করুন, মাটিকে যথেষ্ট ঝুরঝুরে রাখতে হবে।

স্পাইডার প্লান্টে সার প্রয়োগ

স্পাইডার প্লান্টে সার দেওয়ার ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকতে হবে। অতিরিক্ত সার দিল পাতা পুড়িয়ে ফেলতে পারে। গাছের বেড়ে উঠার মৌসুম তথা বসন্ত ও গ্রীষ্মে প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর মাটিতে সামান্য ভার্মি কম্পোস্ট মিশিয়ে দিতে পারেন। এদেশীয় জলবায়ু অনুযায়ী, অন্যান্য মাসগুলোতে মাসে একবার সার দিলেই যথেষ্ট। স্পাইডার প্লান্টের পাতার সজীবতা বৃদ্ধির জন্য ইপসম সল্ট (ম্যাগনেসিয়াম সালফেট) বেশ কার্যকর। প্রতি পনের দিনে একবার দুই লিটার পানিতে  এক চা চামচ ইপসম সল্ট মিশিয়ে স্প্রে করলে তা পাতার জন্য বেশ উপকারী হয়। এই পানি মাটিতে দিলে তা শেকড়ের বৃদ্ধিতে অনেক সহায়তা করে। 

রাসায়নিক সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যালেন্স এনপিকে টবের সাইজ অনুযায়ী বুঝে দুই তিনমাস অন্তর দিতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি জৈবসার দেওয়া সমর্থন করি কারণ রাসায়নিক সারের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে সেটা গাছের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি গাছ মেরেও ফেলতে পারে।

স্পাইডার প্লান্টের পরিচর্যা

স্পাইডার প্লান্টের মাটি সবসময় হালকা ভেজা রাখতে হয়। বিশেষ করে গাছের বৃদ্ধির মাসগুলোতে(বসন্ত ও গ্রীষ্ম) এই বিষয়ে আরও খেয়াল রাখা জরুরী। মাটি যেন সবসময় স্যাঁতস্যাঁতে না থাকে। এতে গাছে পচন ধরে মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্পাইডার প্লান্ট পানির মানের ব্যাপারে একটু খুঁতখুঁতে। পানিতে থাকা ফ্লোরিন বা ক্লোরিন গাছের পাতার আগা বাদামী করে ফেলে।  সেক্ষেত্রে গাছে তুলনামূলক বিশুদ্ধ ও  কেমিক্যাল মুক্ত পানি দেওয়া ভালো। বিশেষ করে বৃষ্টির পানি পেলে তো আর কথাই নেই। 

প্রতিদিন গাছের টবে অল্প করে পানি দেওয়ার বদলে সকালে বা বিকালে পুরো মাটি ভিজিয়ে পানি দিতে হবে যাতে টবের নিচ দিয়ে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়। দুই-তিন দিনের মধ্যে  টবের মাটির ওপরের এক ইঞ্চি শুকিয়ে গেলে পানি দেওয়া উত্তম। 

ট্রপিক্যাল প্লান্ট হবার সুবাদে গাছটি আর্দ্রতা বেশ পছন্দ করে। সেজন্য প্রতিদিন অন্তত একবার গাছে পানি স্প্রে করে দিলে পাতাগুলো বেশ সজীব থাকে। তাপমাত্রা বেশি থাকলে আরও বেশি বেশি স্প্রে করলে ভালো হয়।

ডরমেন্সি বা শীত ঘুমে স্পাইডার প্লান্টের যত্ন

শীতকালে স্পাইডার প্লান্ট ডরম্যান্সি বা শীত ঘুমে চলে যায়। এসময় গাছে কোনো বৃদ্ধি চোখে পড়ে না। দুইএকটা শুকনো পাতা উঁকি দিবে,  ক্ষেত্র বিশেষে পুরো গাছের পাতা মরে যেতে পারে। এর মানে এই নয় যে গাছ মারা গেছে। শীত চলে গেলে মাটির নিচে থাকা বাল্বগুলো থেকে মহাসমারোহে নতুন পাতা জন্মাবে।

স্পাইডার প্লান্টের বংশবিস্তার

স্পাইডার প্লান্টের বংশবিস্তার দুইভাবে সম্ভব।

  • বাল্বের সাহায্যে
  • স্পাইকের সাথে থাকা চারার সাহায্যে

স্পাইডার প্লান্টের বেশ কিছু ভ্যারাইটি শুধুমাত্র বাল্বের সাহায্যে বংশবিস্তার করে। টব থেকে একটা বাল্ব অন্য টবে লাগিয়ে দিলে সেটা নতুন করে গাছের জন্ম দেয় এবং পার্শ্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন বাল্ব তৈরি করে। এভাবে গাছের বৃদ্ধি ঘটে। 

স্পাইডার প্লান্টের স্পাইকের গায়ে ছোট চারা তৈরি হয়। কিছুটা বড় হয়ে গেলে সেগুলোকে আলাদা করে ককোপিটে বসিয়ে দিতে হবে। ককোপিট সবসময় সামান্য ভেজা রাখতে হবে। দুইএক-সপ্তাহের মধ্যে শেকড় আসবে এবং সেগুলোকে আলাদা টবে বসিয়ে দিলে নতুন একটা স্পাইডার প্লান্ট পেয়ে যাবেন।

স্পাইডার প্লান্টের রোগবালাই

স্পাইডার প্লান্টের রোগব্যাধি তুলনামূলক কম। আলো, পানি, সার পরিমাণ মতো দিলে গাছ সুস্থ থাকে, এবং পাতা বাদামী হয়ে যায় না। পাতা বাদামী হওয়া শুরু করলে বাদামী অংশগুলোকে কেটে ফেলুন। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পাতার ক্ষতি হতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে  গাছকে একেবারে ছায়ার মধ্যে নিয়ে আসুন। জুলাইয়ের দিকে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর তাপমাত্রা জনিত কারণে পাতা নষ্ট হবে না।

এছাড়া রুট রট বা শেকড় পচে যাওয়া দেখা দিতে পারে। এ থেকে বাঁচার জন্য ভালো ড্রেনেজযুক্ত মাটি প্রয়োজনীয় এবং সবসময় মাটির ওপরের এক ইঞ্চি শুকনো হবার পরেই পানি দিতে হবে। কিছুদিন পরপর টবের উপরিভাগের কয়েক ইঞ্চি মাটি খুঁচিয়ে দিন। এতে যেমন গাছের শেকড় বৃদ্ধির  সম্ভাবনা বাড়বে, তেমনই দেখতে পাবেন মাটিতে কোনো রোগবালাই বা পোকামাকড় হয়েছে কি না। 

গাছে স্পাইডার মাইটস ও রুট মিলি দেখা দিতে পারে। স্পাইডার মাইট সচরাচর চোখে দেখা যায় না। যখন দেখবেন পাতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পাতারা গায়ে খুব সূক্ষ্ম মাকড়সার জাল দেখা যাচ্ছে, বুঝবেন অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি হিসেবে দলে দলে স্পাইডার মাইটের আগমন ঘটেছে। এমন  অবস্থায় গাছের টব নিয়ে দ্রুতবেগের পানি দিয়ে পুরো গাছ ধুয়ে ফেলবেন। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সপ্তাহে একবার করে গাছে প্রয়োজনীয় মাত্রায়  কীটনাশক  পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করবেন।

স্পাইডার প্লান্টের আরও দুই বিপদের নাম মিলিবাগ ও রুট মিলি। মিলিবাগ পাতার রস শুষে নিয়ে গাছ প্রাণহীন করে তোলে, এবং রুট মিলি  একইভাবে শেকড়ের শক্তি কমিয়ে দেয়।  পাতার গায়ে সাদা মিলিবাগ দেখলে যতদ্রুত সম্ভব সাবান পানি স্প্রে করুন। এটা রুট মিলির গায়ের মোমের কোটিং গলিয়ে দেয় এবং পরদিন কীটনাশক স্প্রে করলে সেটা কার্যকরী হয়। এভাবে পরপর তিনদিন স্প্রে করার পর আশা করি  মিলিবাগের সম্পূর্ণ দমন ঘটবে। পরবর্তীতে আবার মিলিবাগের আক্রমণ ঘটলে একইভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।

স্পাইডার প্লান্টে রুট মিলির দেখা দেয় যদি  গাছে অতিরিক্ত পানি দেওয়া হয়। গাছের উপরিভাগের মাটি খুঁচিয়ে যদি সাদা কিছুর দেখা পান, সেটাই রুট মিলি। তা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় কীটনাশক পানির সাথে মিশিয়ে মাটিতে দিতে হবে প্রতি সপ্তাহে একবার করে।

স্পাইডার প্লান্টের প্রাপ্যতা ও মূল্য

ছোটবড় যেকোনো নার্সারিতে গেলে স্পাইডার প্লান্ট খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে সহজলভ্য ভেরিগেটেড স্পাইডার প্লান্ট আজকাল ২০০-২৫০টাকায় পেয়ে যাবেন। অন্যান্য ভ্যারাইটিগুলো বিভিন্ন মূল্যে পেতে পারেন। এছাড়াও আজকাল বিভিন্ন অনলাইন শপে এই গাছ পাওয়া যাচ্ছে। 

আরেকটা বিষয় না বললেই নয়। স্পাইডার প্লান্টের মতন দেখতে কিন্তু তুলনামূলক ছোট পাতাযুক্ত  স্পাইডার গ্রাস নামক আরেকটি গাছ পাওয়া যায়। এটায় স্পাইক তৈরি হয় না এবং বাল্বের সাহায্যে বংশবিস্তার করে থাকে। স্পাইডার গ্রাস ৪০-৮০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন।

পোষ্য সুরক্ষা ও বিষাক্ততার লেভেল

ASPCA (American Society for the Prevention of Cruelty to Animals)  সহ বিভিন্ন সোর্স অনুযায়ী স্পাইডার প্লান্ট বিড়াল-কুকুরসহ সমস্ত পোষ্যের জন্য নিরাপদ এবং কোনোপ্রকার  বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে না। এর পাতায় থাকা কিছু রাসায়নিক উপাদান বিড়ালদের ওপর ক্যাটনিপের মতন  প্রভাব ফেলে। তাই বিড়ালদের স্পাইডার প্লান্টের পাতার প্রতি আকর্ষিত হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *