ঘরকে বানান অক্সিজেন ফ্যাক্টরি

পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ সমাজে বসবাস করছে। মানুষ এই সমাজকে গড়ে নিয়েছে নিজের মতো করে। মাটি, পানি, বায়ু,  বৃক্ষরাজি এসবই পরিবেশের উপাদান, যা সভ্যতার বিকাশে অপরিহার্য। পৃথিবীর ক্রমবিকাশের সাথে মানুষ নিজেকে করেছে ‘উন্নত’, আর পরিবেশকে করেছে বিপর্যস্ত। অথচ এই বনভূমির বৃক্ষরাজিই মানব জাতির বেঁচে থাকার অন্যতম টোটকা অক্সিজেনের একমাত্র উৎস।

শুধু গাছ বা বন ধ্বংস করেই আমরা থামছি না, বিভিন্ন ভাবে বায়ু দূষন করতে একটুকুও পিছপা হচ্ছি না। অপরিকল্পিত নগরায়ন, যান্ত্রিক ইঞ্জিনের বহুল ব্যাবহার, ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধন নিয়মিতই আমাদের আবহাওয়াকে উষ্ণ করে চলেছে।  ফলে ক্রমাগত স্বাস্থঝুকি, ফুসফুসের বিভিন্ন প্রদাহসহ বাড়ছে উদ্বীগ্নতা, বিষন্নতা,  অনিদ্রা বা ইনসোম্যানিয়া। অথচ শুধুমাত্র অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়িয়ে আপনি এসকল ঝামেলা মুক্ত থাকতে পারেন। বেশি মাত্রার অক্সিজেন মস্তিষ্ককে ঠান্ডা রাখে ও অনিদ্রা দূর করতে পারে।

এজন্য যে আপনাকে বনভূমিই গড়তে হবে এমনটা নয়। আপনি চাইলেই আপনার অফিস, বারান্দা, সিড়ির ল্যান্ডিং, চিলেকোঠা, রান্নাঘর এমনকি শোবার  ঘরেও তৈরি করতে পারেন অক্সিজেন ফ্যাক্টরি।

যারা পড়ছেন, হ্যাঁ অক্সিজেন ফ্যাক্টরিই বানিয়ে ফেলা সম্ভব। দেখে নেয়া যাক এমন কিছু গাছ যেগুলো “নাসা ক্লীন এয়ার স্টাডি”তে পরিক্ষিত ও আপনার বেডরুমে বা ব্যাক্তিগত স্থানে স্বল্প পরিসরে থেকেও দিতে পারে আপনার জন্য যথেষ্ট  অক্সিজেনের জোগাড়। এ ধরনের অনেক গাছ আছে যারা সরাসরি সূর্যালোক না পেলেও জীবন ধারনে কোন প্রভাব পড়ে না। তাই এই গাছ গুলো ঘরেই রেখে সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি বাসার বায়ুকে করতে পারেন নির্মল।

স্নেক প্লান্ট

পশ্চিম আফ্রিকার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল নাইজেরিয়ার পশ্চিম থেকে কঙ্গো স্নেক প্লান্টের আদি বাসস্থান। এটি একটি চিরসবুজ গাছ।  নাসা রিসার্চ সেন্টার দ্বারা পরিক্ষিত যে- স্নেক প্লান্ট প্রকৃতি থেকে নাইট্রোজেন  অক্সাইড,  ফরমালডিহাইড,  জাইলিন, বেনজিন, ট্রাইক্লোরো-ইথিলিন  এর মত টক্সিক গ্রহন করে আপনার কক্ষ বাতাস করে পরিশুদ্ধ।

 এই গাছটি বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমায় ও হালকা পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। রাতেরবেলা এরা অধিক পরিমান অক্সিজেন নির্গমন করে আপনার শোবার ঘরকে ঘুমের জন্য আরোও আরামদায়ক করে তোলে। স্নেক প্লান্ট তাই অমাদের ঘরোয়া গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে এক নাম্বারে।

এলোভেরা

এরাবিয়ান পেনিন্সুয়ালা জন্মস্থান হলেও এলোভেরা গাছ পৃথিবীর নাতিশীতোষ্ণ,  স্বল্প নাতিশীতোষ্ণ ও মরু আবহাওয়ায় জংলী গাছ হিসেবে বেড়ে ওঠে।

এ গাছ চেনে না এমন মানুষ কম। প্রকৃতিতে এলোভেরা এক বিস্ময়ের নাম। ত্বকের ডাক্তার এইগাছ রূপচর্চা থেকে শুরু করে খাওয়া কোন কাজে লাগে না?

আবার বাতাস থেকে বেনজিন ও ফরমালডিহাইড এরমত টক্সিন দূর করতেও বেশ পটু এই গাছ। এরা সরাসরি সূর্যালোক ব্যাতিত বাচতে পারে। রাতের বেলা অক্সিজেন সরবরাহে এই গাছের জুড়ি নেই। প্রাপ্তবয়স্ক গাছের গোড়াতেই নতুন এলোভেরা গাছের কুড়ি জন্মায়। তাই এই গাছ একবার সংগ্রহ করে যত্ন করলেই আর কিনতে হয় না। এই বিস্ময় বৃক্ষকে তাই আমরা রেখেছি দ্বিতীয় অবস্থানে।

স্পাইডার প্লান্ট

দক্ষীন আফ্রিকা ও নাতিশীতোষ্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের চিরসবুজ গাছ স্পাইডার প্লান্ট। গাছটি রুমে, অফিসে বা রান্নাঘরে টবে বা ঝুলিয়েও রাখা যায়। রান্নাঘরের দূষন নিয়ন্ত্রনে রাখে বলে অনেকেই একে কিচেন প্লান্ট বলেও আখ্যায়িত করেন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ইনডোর প্লান্ট এটি। খুবই সহজ পরিচর্যা পদ্ধতি এর জনপ্রিয়তার অন্যাতম কারন। বাতাসের ডাক্তার এই গাছ বাতাস থেকে কার্বন মোনোক্সাইড, বেনজিন, ফরমাল্ডিহাইড দূর করে। অক্সিজেন দেবার ক্ষমতাও বেশ। সরাসরি সূর্যালোক ব্যাতিত বেঁচে থাকার উপযোগিতা একে ইনডোর প্লান্ট এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ গাছ মানুষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে সহায়তা করে বিষন্নতা ও উদ্বেগ দূর করে। গাছটি আমাদের রিকমেন্ডেশন লিস্টে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।

জারবেরা ডেইজি

জারবেরার দক্ষিন আফ্রিকান প্রজাতি জারবেরা ডেইজি পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ফুলগুলোর একটি।

নাসা ক্লিন এয়ার স্টাডি রিসার্চ’এ প্রাপ্ত এই গাছ বাতাসের বিষাক্ত ফরমালডিহাইড, বেনজিন, ট্রাইক্লোরোইথিলিন দূর করে। রাতের বেলা কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহন করে বাতাসে অক্সিজেন ছড়িয়ে দিতে এর তুলনা নেই।

এর পাশাপাশি জারবেরা ডেইজি পৃথিবির সবচেয়ে সুন্দরতম ফুলগুলোর একটি। এর মনোমুগ্ধকর রঙ আপনাকে নিঃশ্বাস নিতে ভুলিয়ে দেবে। খুব সহজেই টবে বা বাক্সে একে রোপন করা যায়। 

এরিকা পাম

মাদাগাস্কার দ্বীপবাসী এরিকা পাম গাছ সোনালী আখ পাম, বাশ পাম, প্রজাপতি পাম অনেক নামেই জনপ্রিয়। এরিকাশিয়া গোত্রের একমাত্র গাছ যা ঘরোয়া গাছ হিসেবে সমাদৃত।  জন্মস্থান মাদাগাস্কার হলেও একে ফ্লোরিডা, জ্যামাইকা, পুয়োরতো রিকো, ক্যানারি আইল্যান্ড, আন্দামান দ্বীপেও পাওয়া যায়।

পামগাছ রুমে সহজেই টবে রোপন করা যায়। সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি এ গাছ বাতাসের ধুলিকনা রোধ করে, অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ায়। বাতাস শুধু বিশুদ্ধই নয়, এই গাছের উপস্থিতি শিশুদের ও মায়ের গর্ভের সন্তানদের সঠিক বিকাশে সহায়তা করে। দেহের স্নায়ুতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।

বাঁশ

পৃথিবীর সরবত্র পাওয়া যায় বাঁশ গাছ। এর আদিবাস হিসেবে অনেকে চীনকে মনে করেন, কারন চৈনিক জাতিই পৃথিবীতে প্রথম সকল দৈনন্দিন উপাদান বাশ দ্বারা তৈরি ও ব্যাবহারের ইতিহাস দেখায়। অনেকেই জাপানকে এর বাড়ি বলে অভিহিত করেন।

বাঁশ গাছ ছোট টবে অফিসে বা রুমে রোপন করা যায়। এটি বাতাস হতে বিষাক্ত টুলিন গ্যাস শোষন করে। টুলিন বরনহীন ঝাঝালো গ্যাস যা চোখে, মুখে, গলায় এলারজি জনিত সমস্যা ঘটায়। এছাড়া বাশ ফরমাল্ডিহাইড, বেনজিন ও শোষন করে থাকে। প্রচুর অক্সিজেনের যোগান দিতে পারে গাছটি।

ফিকাস

ফিকাস গাছ বহুলভাবে উইপিং ফিগ নামে পরিচিত। এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের আদিবাসী এই গাছটি ব্যাংকক এর অফিশিয়াল গাছ। চির সবুজ এই গাছের অনেক গুলো জাতের মধ্যে ফিকাস বেঞ্জামিনাই ঘরোয়া গাছ হিসেবে পরিচিত।

নাসা দ্বারা পরিক্ষিত এই গাছ বাতাস হতে ফরমাল্ডিহাইড, কার্বন মনোক্সাইড, টুলিন দূর করে। নাসা একে সর্বশ্রেষ্ঠ বাতাস পরিশোধক হিসেবে আখ্যায়িত করে। গাছটি বনসাই হিসেবেও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। 

তুলসি

ভারতীয় উপমহাদেশ ও এশিয়ান নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলগুলোতে তুলসী গাছ প্রথম সনাক্ত করা হয়। হোলি বেসিল নামের এই গাছ জনপ্রিয় তার ঔষধী গুনের জন্য।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র এই গাছটি দুষ্ট আত্মা থেকে ঘরকে রক্ষা করে,  ঘরে সুসাস্থ ও সৌভাগ্য আনে বলে অনেকেই বিশ্বাস করে । 

তবে গাছটি বৈজ্ঞানিক ভাবে বাতাস থেকে সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন—মোনোক্সাইড, কারবন ডাই অক্সাইড শোষন করে। তুলসী গাছ প্রকৃতিতে ২০ ঘন্টা অক্সিজেন সাপ্লাই করে যা গাছেদের মধ্যে দীর্ঘ। গাছটি আপনার ঘরের বাতাসকে নিঃসন্দেহে আরো নিরমল করবে। 

পথোস প্ল্যান্ট

 বহুল জনপ্রিয় লতানো বহুবর্ষজীবী চিরসবুজ গাছটি ডেভিলস আইভি ও মানিপ্ল্যান্ট নামে অধিক পরিচিত। ফ্রান্সের পলিনেশিয়ান অঞ্চলের বাসিন্দা এই গাছ বাংলাদেশেও বিপুল পরিমানে দেখা যায়। ঘরোয়া গাছ হিসেবে আর সহজ লালন পালন, যত্ন প্রক্রিয়া গাছটি জনপ্রিয়তার শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে । বাতাস থেকে বেনজিন, কারবন মনোক্সাইড, ফরমাল্ডিহাইড শোষণ করে। পাশাপাশি অক্সিজেন নিঃসরন করে মনে করিয়ে দেয় গাছ আমাদের পরম বন্ধু।

তাই আজই প্ল্যান করে ফেলুন একটি ছোট উদ্যানের যা আপনার পরিবারের অক্সিজেন ট্যাংক হিসেবেও করতে পারেন। পছন্দ অনুযায়ী কিনে নিন আপনার অক্সিজেন ইনডোর প্ল্যান্টগুলো। আপনার ঘরকে করে তুলুন প্রানবন্ত সবুজ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *