উদ্ভিদ প্রেমি মানুষ চায় তার ঘরের সর্বত্র বিরাজ করুক সবুজের আভা। গাছ ঘরকে সতেজ ও নির্মল করে তোলে। অনেকেই আছেন যাঁরা বাগানের যত্ন করার মতো সময় পান না অথবা বাগান করার ইচ্ছা, অথচ জায়গা নেই। তাদের জন্য টেরারিয়াম গাছ লালন পালনের অন্যতম মাধ্যম। খুব অল্প জায়গায় সবুজের নতুন জগত টেরারিয়াম। আমাদের দেশে এটি তেমন জনপ্রিয় নয়। নতুই অনেকেই ঘরে টেরারিয়াম রাখছে। আসুন টেরারিয়াম সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য জেনে রাখি।
টেরারিয়াম কী?
সহজ করে বললে কাঁচের তৈরি জার বা বাক্সে বনের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করাই হচ্ছে টেরারিয়াম। টেরা মানে শুষ্ক ভূমি বা ভূপৃষ্ঠ, সেই পৃষ্ঠে নতুন বন সৃষ্টি করা হয়। এখানে থাকা উদ্ভিদ বাইরের দুনিয়া থেকে আলো ও তাপ ছাড়া কোনো রসদ সংগ্রহ করে না। পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো নিজে থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। টেরারিয়াম বদ্ধ ও খোলা উভয় প্রকারের হতে পারে।ঘরের অলংকার হিসাবে শোভা বাড়ায়। স্বচ্ছ কাঁচের মধ্যে সহজেই আলো ও তাপ প্রবেশ করে। ফলে এর ভিতরে পানিচক্র তৈরি হয়। উচ্চ তাপমাত্রা এর ভিতরেই বাষ্পীভূত হয়। জলীয় বাষ্প টেরারিয়ামের দেয়ালে ঘনীভূত হয়ে গাছপালা ও নিচের মাটিতে ফিরে আসে। পানিচক্রের মাধ্যমে গাছগুলো শুষ্ক হয় না। স্বচ্ছ কাচের গ্লাসের জন্য উদ্ভিদ তার সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে
ইতিহাস
টেরারিয়ামের ইতিহাস অনেক পুরানো। ভিক্টোরিয়ান যুগে ১৮৪২ সালে উদ্ভিদ-বিদ নেতালিয়ান বাগশো ওয়ার্ড, মথ ও ক্যাটারফিলার নিয়ে গবেষণা করেন। ওয়ার্ড পোকামাকড় নিয়ে গবেষণা করতে দুর্ঘটনাবশত একটি কাচের জারকে ফেলে রেখেছিল। যেটাতে ফার্ন স্পোর বেড়ে উঠে এবং অসচেতনতা জন্য প্রথম টেরোরিয়ামে পরিণত হয়। তখন ইংরেজরা টেরারিয়াম এর প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে। এটি ওয়ার্ডিয়ান কেস নামে পরিচিত। ওয়ার্ড এরপর অট্রেলিয়ার সিডনিতে ব্রিটিশ গাছপালা কাচের পাত্রে রেখে গবেষণা করে। এমতাবস্থায় কিছু জার বন্দি গাছ সিডনি থেকে লন্ডনে পাঠায়৷ সবগুলো গাছই কাচের পাত্রে অক্ষত অবস্থায় ছিলো। তার পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায় গাছপালা বায়ু চলাচল ছাড়াই কাচের পাত্রে বাঁচতে পারে। এরপর হতেই টেরারিয়াম এর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এটি বেশ জনপ্রিয়।
প্রকারভেদ
টেরারিয়ার দুই ধরণের হয়ে থাকে। একটি খোলা টেরারিয়াম অন্যটি বন্ধ টেরারিয়াম। বন্ধ টেরারিয়াম এর মুখ ঢাকনা বা কর্ক দিয়ে ঢাকা থাকে। খোলা টেরারিয়াম বাতাস ঢুকার পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। ফলে এরা মুক্ত ও তাজা বাতাস পায়।
বন্ধ টেরারিয়াম
বন্ধ টেরারিয়াম এর পরিবেশ থাকে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও আর্দ্র। এটি বন্ধ থাকার জন্য ভিতরেই পানিচক্র বিদ্যমান থাকে। এটিকে সয়ংসম্পূর্ণ টেরারিয়াম বলে। এর জমে থাকা বাতাস ও কাচ থেকে অতিরিক্ত আদ্রতা কমানোর জন্য একে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার খোলা প্রয়োজন। এর ফলে শেওলা বৃদ্ধি রোধ পায়। বন্ধ টেরারিয়ামে আদ্রতা কমে গেলে পানি স্প্রে করতে হবে। মাটিতে জীবাণুর আক্রমন কমাতে মাটির বিশেষ মিশ্রণ ব্যবহার করা যায়।
খোলা টেরারিয়াম
এটি সব ধরনের গাছের জন্য উপযোগী। বিশেষ করে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উদ্ভিদ। এখানের গাছগুলোর জন্য অতিরিক্ত আর্দ্রতার প্রয়োজন পড়ে না। এতে এমন উদ্ভিদ রাখা দরকার যেগুলো সরাসরি সূর্যালোক প্রয়োজন হয়। বন্ধ টেরারিয়াম প্রচুর তাপ আটকে রাখতে পারে কিন্তু খোলা টেরারিয়াম তা পারে না।
জীবনচক্র
টেরারিয়ামের জীবনচক্র খুব আশ্চর্যের। প্রথমে টেরারিয়াম বানাতে যথেষ্ট আদ্রতা দিয়ে মাটিকে সিল করা হয়। মাটি থেকে উদ্ভিদ পানি সংগ্রহ করে প্রস্বেদন করে পাতার তৈরি পানি ঘনীভূত হয়ে আবার মাটির আর্দ্রতা ফিরিয়ে দেয়। আলোর সাহায্যে এরা অক্সিজেন তৈরি করে শ্বসন প্রক্রিয়া চালু রাখে। কর্বন—ডাই —অক্সাইড সালোকসংশ্লেষণ করতে সহায়তা করে। এভাবে অক্সিজেন ও কার্বন— ডাই —অক্সাইড চক্র চালু থাকে৷ টেরারিয়ামে থাকা উদ্ভিদের পাতা মাটিতে পড়ে পচে সার তৈরি হয় ও নতুন চারাগাছ জন্মায়। এভাবেই কাচের জারের ভিতরেই জন্ম মৃত্যু চক্র চলতে থাকে। এককথায় বলতে গেলে টেরারিয়াম পৃথিবীর মধ্যে অন্য এক পৃথিবী। সবথেকে প্রাচীন টেরারিয়াম ৪০ বছরে মাত্র একবার খোলা হয়েছে। চাইলে টেরারিয়ামে সরিসৃপ, উভচর প্রাণী বা কীটপতঙ্গ রাখা যায়। প্রকৃতি তার নিয়ম মেনে এদের বৃদ্ধি ও ভারসাম্য রক্ষা করে।
কীভাবে টেরারিয়াম তৈরি করবেন
ঘরে সহজেই টেরারিয়ামে বানানো যায় তবে বাজারের টেরারিয়াম বা ফ্লোরারিয়াম নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়, নিজের হাতে তৈরির চেয়ে সেগুলো বেশি নান্দনিক ও সুন্দর। তাছাড়া আবদ্ধ টেরারিয়াম তৈরি খুব জটিল প্রকৃয়া। বাসায় নিজে টেরোরিয়াম বানাতে অবশ্যই খোলা টেরারিয়াম দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমে কাচের ফিশবোল, জার, বড় অ্যাকুরিয়াম নিতে হবে। এতে ছোটো পাথরের টুকরো, কয়লা, চারকোল, নুড়ি, ঝুরো বালি, মাটি দিতে হবে। প্রথমে দেড় ইঞ্চি পুরু পাথরের স্তর, এর উপর কাঠ— কয়লার স্তর, তারপর অন্যান্য উপাদান ও সবশেষে মাটি ব্যবহার করবেন। উদ্ভিদ কী ধরণের তার উপর ভিত্তি করে মাটির পুরুত্ব নির্ধারণ করতে হবে৷ লক্ষ্য রাখতে হবে মাটিতে যেন বাতাস ভালোভাবে চলাচল করতে পারে। অতিরিক্ত পানি অপসারণ ব্যবস্থা রাখতে হবে৷ এবার মাটিতে নুড়ি পাথর দিয়ে সাজিয়ে পছন্দসই উদ্ভিদ লাগিয়ে ফেলুন। উদ্ভিদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে মস,ফার্ন, ক্যাকটাস অ্যালুমিনিয়াম প্লান্ট, সাকুলেন্ট জাতীয় উদ্ভিদ নির্বাচন করুন। এসব উদ্ভিদের কাণ্ড, শাখা,মূল পানি সঞ্চয় করে রাখতে পারে। টেরারিয়াম সাজানো শিল্পকর্মের পর্যায়ে পড়ে। মনের মাধুরি মিশিয়ে তৈরি করা যায় এসব টেরারিয়াম। আপনার ঘরের টেরারিয়ামের মাধ্যমে রূচি ও শিল্পবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
যত্ন
টেরারিয়াম খুব বেশি যত্ন লাগে না। তবে ছোট ছোট কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। সরাসরি সূর্যালোক পরিহার করতে হবে৷ আর্দ্রতা কমে গেলে পরিমিত পানি স্প্রে করুন। খেয়াল রাখতে হবে যাতে মাত্রাতিরিক্ত পানি প্রয়োগ না হয়। অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প জমলে টেরারিয়ামের ঢাকনা খুলে দেবেন। ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ থেকে কীটনাশক ব্যবহার করবেন। সারের প্রয়োজন পড়লে লিকুইড সার স্প্রে করতে পারেন। এয়ার কুলার বা এয়ার কন্ডিশনার রুম পরিহার করুন। টেরারিয়ামের তাপমাত্রা দ্রুত পরিবর্তন না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
টেরারিয়াম অত্যন্ত সুন্দর একটি জিনিস। ঘরের ভিতরে খুব অল্প জায়গায় রাখা যায়। এটি আপনার ঘরের অলংকার হিসাবে কাজ করবে। যদি কোনো আমন্ত্রিত অতিথি আসে তবে সে মুগ্ধ হবে টেরারিয়াম দেখে৷ তাছাড়া আপনি সবুজের প্রশান্তি পাবেন। কমবে মানসিক স্ট্রেস৷