এয়ার প্লান্ট সমাচার

নাগরিক জীবনে, জীবন— জীবিকার তাগিদে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যস্ত হয়ে পড়ছি, অতিরিক্ত ব্যস্ততার জন্য আমাদের অবসর সময় ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ফলে বাগান কিংবা ইনডোর প্লান্টের যত্নে আমরা আগের মতো সময় দিতে পারছি না। আমাদের শখ ও বাগান করার স্বপ্ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খুব সহজে অল্প পরিচর্যায়, অল্প জায়গায় ঘরে রাখা যায় এয়ার প্লান্ট। অনেকের কাছে এটি নতুন একটি নাম। এই গাছের জন্য লাগবে না মাটি বা ককোপিট, শুধুমাত্র পর্যাপ্ত  আলোবাতাসেই বাঁচবে ও বেড়ে উঠবে উদ্ভিদ। আপনার বারান্দায়, বৈঠক কক্ষের জানালার পাশে অথবা শোবার ঘরের যেখানে আলো বাতাসের পর্যাপ্ততা রয়েছে এমন জায়গায় এয়ার প্লান্ট রাখতে পারেন। যা আপনার শৌখিন, রুচিশীল মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। 

এয়ার প্লান্ট পরিচিতি 

এয়ার প্লান্ট নামটি শুনেই বোঝা যায় এই উদ্ভিদের কোনভাবে বাতাসের সাথে সংযোগ রয়েছে। এর বেড়ে উঠতে কোন মিডিয়ার প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র বাতাস ও আলোর মাধ্যমে জীবন ধারণ করতে পারে এই উদ্ভিদ। এয়ার প্লান্টের প্রায় ৬৫০ প্রজাতি রয়েছে। এরা ব্রোমোলিয়াসি পরিবারের অন্তর্গত। এরা চিরহরিৎ, বহুবর্ষজীবী সম্পূরক উদ্ভিদ। বিশেষ কোষ (ট্রাইকোম) দিয়ে এদের গায়ে জমে থাকা পানি শোষণ করে। ট্রপিকাল রেইনফরেস্ট, যে বন গুলোতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় অর্থাৎ অ্যামাজন, থাইল্যান্ড, মালোয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়ার বনাঞ্চলে অধিকাংশ এয়ার প্লান্ট জন্মে। তাছাড়া ম্যাক্সিকো, অ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়ার মরু অঞ্চলে এর বিশেষ প্রজাতির দেখা মিলে। আমাদের দেশে যেসব এয়ার প্লান্ট দেখা যায় তার অধিকাংশ থাইল্যান্ড ও মালোয়শিয়া থেকে আমদানি করা হয়। 

তাপমাত্রা ও বায়ু 

এয়ার প্লান্টের জন্য বেশ আর্দ্র ও মুটামুটি তাপমাত্রা থাকে এমন পরিবেশ প্রয়োজন। এরা গ্রীষ্মকালীন উদ্ভিদ, শীতকালে এদের বৃদ্ধি খুব কম হয়। তাপমাত্রা পছন্দ করলেও এরা সরাসরি সূর্যালোক পছন্দ করে না। সূর্যের তাপে সরাসরি এই উদ্ভিদ রাখলে এর পাতার কিনারা পুড়ে বাদামি রঙ ধারণ করে। এয়ার প্লান্ট রাখতে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেখানে পরোক্ষভাবে প্রচুর সূর্যালোক আসে ও খুব ভালো বাতাস চলাচল করে। এয়ার প্লান্টের স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে টেরোরিয়াম পরিহার করা উচিৎ। এই গাছের বৃদ্ধিতে যেহেতু বায়ুর প্রয়োজন তাই প্রচুর বাতাস প্রবাহিত হয় এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। রেইনফরেস্ট এয়ার প্লান্ট ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বেশি হলে এর পাতার কিনারা পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সরাসরি সূর্যালোক পরিহার করা উচিৎ। 

পানি ও আর্দ্রতা 

এয়ার প্লান্টে পানি প্রদান ও আর্দ্র রাখার কয়েকটি পন্থা রয়েছে। এরা আর্দ্রতা খুব পছন্দ করে৷ সাধারণত আর্দ্র রাখতে ভোরে এর গায়ে পানি স্প্রে করতে হবে। 

গরমকালে এয়ারপ্লান্টের নিচে একটা হাড়িতে পানি রাখুন। গরমে বাতাস বাষ্পীভূত হয়ে এয়ার প্লান্টের আর্দ্রতার চাহিদা পূরণ করবে৷ সমসময় ভেজা ভেজা থাকলে এর স্বাভাবিক বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। 

পানি প্রদানের জন্য, পরিষ্কার বালতিতে পরিমাণ মতো পানি নিয়ে গরমের দিনে ৭ দিন ও শীতের দিনে ১৫ দিন পরপর ৩০ মিনিটের জন্য পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পানি থেকে তোলার পর চেষ্টা করবেন, এর গায়ে লেগে থাকা অতিরিক্ত পানি অপসারণ করতে। তাই এয়ার প্লান্টকে পানি থেকে উত্তোলনের পর একে উল্টো করে রাখবেন। এজন্য প্লাস্টিকের বোল, অথবা পত্রিকা ব্যবহার করুন।  পাতার ভিতরে জমে থাকা পানি না ঝরালে দুইদিনের মধ্যে আপনার সাধের এয়ার প্লান্ট পচে যেতে পারে। তবে বিশেষ চরিত্রের বালবুসা, ক্যাপাট— মেডুসে অর্থাৎ  যেগুলো নিম্নাংশ বৈদ্যুতিক বাল্ব আকৃতির তাদের পানিতে ডুবিয়ে রাখা যাবে না। এসব বিশেষ প্রজাতির গোঁড়ায় পানি ঢুকলে পচে যায়। 

শহরাঞ্চলের পানি সাধারণত দুই ধরণের হয়। শোধনাগার ও ডিপ টিউবওয়েলের। শোধনাগাররে পানিতে প্রচুর ক্লোরিন থাকে যা আপনার এয়ার প্লান্টের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এক্ষেত্রে ডিপ টিউবওয়েলর পানি অথবা ফিল্টার কারা পানি ব্যবহার করবেন। ফিল্টার পানিতে ক্লোরিন সহ বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান থাকে না। 

বর্ষাকালে এয়ার প্লান্টকে কিছুক্ষণ ভিজতে দিতে পারেন। তবে সময়সীমা ৩০ মিনিট। ভেজানোর পর অবশ্যই গাছ থেকে পানি ঝরাতে হবে। 

ঘরে অ্যাকুরিয়াম থাকলে ১০-১৫ দিন পরপর অ্যাকুরিয়ামের পানি এয়ার প্লান্টে স্প্রে করবেন। অ্যাকুরিয়ামে মাছ থাকার ফলে এর পানিতে প্রচুর নাইট্রোজেন থাকে। যা এয়ার প্লান্টের জন্য উপকারি উপাদান। 

সার

অনন্য উদ্ভিদের মতো এয়ার প্লান্টেও সার প্রয়োগ করা যা। ইউকে ও থাইল্যান্ডের কিছু লিকুইড সার পাওয়া যায়। এগুলো সাধারণত স্প্রে আকারে প্রয়োগ করতে হয়। নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম এর সমন্বয়ে এনপিকে ১৯-১৯-১৯ সার পাওয়া যায়। এটা অর্কিডের জন্য হলেও কিছুটা পাতলা মিশ্রণ করে এয়ার প্লান্টে স্প্রে করা যায়। প্রাকৃতিক জৈব সারও এয়ার প্লান্টে ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে লিকুইড খৈল পচা ১০০ ভাগ পাতলা করে ( ১ কেজির দ্রবণকে ১০০ লিটার পানিতে মিশালে যেমন হবে) ব্যবহার করতে হবে। 

দেশের আবহাওয়া উপযোগী কিছু এয়ার প্লান্ট

আমার দেশে প্রাকৃতিক ভাবে কোন এয়ার প্লান্ট জন্মে না। এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। রেইনফরেস্ট বা মরু অঞ্চল থেকে এগুলো এদেশে অনা হয়। এয়ার প্লান্টে মাটি লাগে না তাই বাতাস, আর্দ্রতা, তাপমাত্রায় বিশেষ নজরদারি করলেই এসব উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও নতুন উৎপাদন সম্ভব। এয়ার প্লান্টের কিছু কমন ভ্যারাইটি নিয়ে আলোচনা করবো। 

তিলান্দসিয়া আয়নান্থ

এটি ব্রমেলিয়াসি পরিবারের চিরহরিৎ উদ্ভিদ। আদি নিবাস রেইনফরেস্ট এর বনাঞ্চল। গাছের হলুদ পুং কেশর বেগুনি এরা নীল ফুল উৎপন্ন করে।  ফুল আসলে পাতাগুলো লাল রঙ ধারণ করে। সহজে মারা যায় না তিলান্দসিয়া আয়নান্থ। খুব সামান্য যত্নেই এরা বেড়ে উঠে। প্রতিদিন পানি স্প্রে করলে আর ১৫-২১ পরপর পানিতে ডুবিয়ে রেখে পানি ঝরিয়ে নিলেই হলো। ফুল ফোটার পর মাতৃ গাছের পাশেই কুশি দিয়ে বাচ্চা গাছ জন্মায়। যারা এয়ার প্লান্টে নতুন তাদের জন্য এই গাছ বেশ উপযোগী। 

আয়নান্থ ফুইগো

আয়নান্থ ফুইগো সরাসরি সূর্যালোক পছন্দ করে না। এর আদি নিবাস ম্যাক্সিকো ও মধ্য আমেরিকায়। পাতার অগ্রভাগ লাল রঙ ধারণ করে যা সত্যিই চমৎকার। আয়নান্থ ফিউগো দ্রুত বর্ধনশীল। চারপাশে এর বৃদ্ধি পায় তাই খুব দ্রুত গোলাকার রূপ লাভ করে৷ বাঁশ, পাথর বা তারের সাথে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। যত্ন বলতে পানি স্প্রে,পানিতে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা ও পানি ঝরিয়ে নেওয়া। 

ফ্রান্কিয়ানা

দেখতে অনেকটা কাঠবিড়ালির লেজের মতো। ম্যাক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকায় এটি জন্মে। সূর্যের পরোক্ষ আলো পছন্দ। দ্রুত বর্ধনশীল এই গাছে কমলা ও হলুদ রঙের ফুল ফোটে। ফুলটি ৭ দিন স্থায়ী হয়। পরিপক্ব বয়সে এতে ফুল আসে। এরপর এই উদ্ভিদ অনেকটা হলুদ হয়ে যায়৷ এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পাতা সামনের অংশ হলুদের পরই মাতৃগাছ কুশি দেয় এবং সেখান থেকেই নতুন গাছ পাওয়া যায়। 

তিলান্দসিয়া ক্যাপট— মেডুসে

ক্যাপট— মেডুসে ব্রোমেলিড পরিবারের উদ্ভিদ এর শাখা পরিবার তিলান্দসিয়েডি। ক্যাপট— মেডুসে বলার কারণ হচ্ছে, গ্রীক পৌরাণিক দেবী মেডুসার চুল যেমন কোঁকড়ানো, আঁকাবাঁকা, সর্পিল ঠিক এই উদ্ভিদের পাতাও আঁকাবাঁকা সর্পিল। এগুলো বাল্ববোফাইলাম টাইপের অর্থাৎ এর নিচের অংশ বাল্ব বা পেয়াজ এর মতো৷ এই জাতীয় উদ্ভিদকে পানিতে ভিজিয়ে রাখা যায় না। এর ভিতরে পাবি ঢুকলে তা বের হতে পারে না। পানি জমে থাকলে গোড়া পচে যায় এবং গাছ সহজেই মারা যায়। সরাসরি বৃষ্টির পানি পরিহার করতে হবে। 

তিলান্দসিয়া জেরোগ্রাফিকা

ম্যাস্কিকো, এল সালভাদোর, গুয়েতেমালা, হনডুরাস অঞ্চলের উদ্ভিদ তিলান্দসিয়া জেরোগ্রাফ্রিকা৷ জেরোগ্রাফিকা আসলে মরু বা শুষ্ক অঞ্চলে হয়ে থাকে। আকারে গোল এই উদ্ভিদ প্রায় ১ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বাড়তে পারে। এর জন্য আর্দ্রতার খুব বেশি প্রয়োজন নেই। প্রাকৃতিক ভাবে এর পানির চাহিদা নেই বললেই চলে। তাই পানিতে ডুবিয়ে রাখার কোনো প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য এয়ার প্লান্ট থেকে তিলান্দসিয়া জেরোগ্রাফিকা অনেক গরম সহ্য করতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে মাঝ বরাবর লাঠির মতো লম্বা বের হয় এবং এর আগায় কমলা,লাল, হলুদের মিশ্রিত ফুল ফোটে। 

অল্প যত্নে বেড়ে উঠে এসব এয়ার প্লান্ট। গাছ পরিচর্যায় নেই তেমন ঝামেলা। দেখতেও সুন্দর। কোনপ্রকার মাটির ব্যবহার না থাকায় এসব উদ্ভিদ যেমন ইচ্ছা তেমন রাখা যায়। তাই আপনার গাছকে ভালোবাসলে আপনার পছন্দের তালিকায় অবশ্যই এয়ার প্লান্ট রাখুন। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *