তুলসী গাছের কথা

তুলসী একটি চিরহরিৎ গুল্ম প্রজতির উদ্ভিদ। এটি আমাদের অত্যন্ত সুপরিচিত গাছ । তুলসী শব্দের আক্ষরিক অর্থ তুলনা হয় না। এই গাছ লামিয়াসি পরিবারের অন্তর্গত। মুলত ঔষধি গাছ হলেও বাড়ির ছাদে,জানালার পাশে, বারান্দায় শোভাবর্ধক হিসেবে কাজ করে। এই গাছ প্রচুর অক্সিজেন ফ্লো করে তাই বায়ু পরিস্কারক গাছ হিসেবে বিবেচিত।  তুলসীর আদি নিবাস অখন্ড ভারতবর্ষে। বাংলাদেশে তুলসী বানিজ্যিকভাবে চাষ না হলেও ভারতে এর বানিজ্যিক চাষ হয়। বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানি ঔষুধের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে। খুব সহজেই এর চারা সংগ্রহ করা যায় ও অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন হয় না। দিনে মাত্র ৪ ঘন্টা আলো পেলেই গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে। ইনডোর প্লান্ট হিসেবে আপনি ঘরে তুলসীকে রাখতে পারবেন। 

তুলসী গাছ

তুলসী গাছ ২-৩ ফুট উঁচু হয়। এই গাছ চার ধরণের হয়। গুল্ম স্থায়ী কান্ডবিশিষ্ট। শাখাপ্রশাখার উপরিভাগে পুষ্পদন্ড থাকে। পাতাগুলো খাঁজকাটা ও ২-৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পুষ্পদন্ডের চারদিকে  ফুল থাকে। প্রতি স্তরে ৬টি ফুল ফোটে। এর পাতাগুলো স্বাদে ঝাঁঝালো। ঔষধি ভেষজ হিসাবে এর ব্যপক পরিচিতি। জুলাই আগস্ট ও নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে এতে মঞ্জরী দেখা দেয়। আমাদের দেশের সর্বত্র তুলসী জন্মায়, তাছাড়া ভারতে এই গাছ প্রচুর দেখা যায়। হিন্দুধর্মে রয়েছে এর বিশেষ গুরুত্ব। 

বানিজ্যিকভাবে তুলসী চাষ

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের চাষিরা তুলসীর বানিজ্যিক উৎপাদন করছে। মাত্র তিন মাসে ১৫- ২০ হাজার টাকা খরচ করে তিন চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। তুলসীর বীজ ও পাতার বিশেষ চাহিদা রয়েছে। বীজ ১৫০-২০০ টাকা আর তেল ৮০০-১০০০ টাকা লিটারে বিক্রি হয়। লবঙ্গ তেলের তুলনায় তুলসীতে ৭০% বেশি ইউনজেনল রয়েছে। বিভিন্ন ঔষধ এর কাঁচামাল হিসাবে এর কদর সমাদৃত। বাংলাদেশে এর বানিজ্যিক চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। কেননা এদেশের মাটি তুলসী চাষে বিশেষ উপযোগী। 

শহুরে জীবনে তুলসী রোপন

নানাবিধ কারণে আমাদের প্রতিনিয়ত শহর কেন্দ্রিক হতে হচ্ছে। ক্রমশই কমে যাচ্ছে সবুজ। চারিদিকে গাড়ির হর্ণ আর মানুষের কোলাহল। গাছ লাগানোর জন্য নেই পর্যাপ্ত উঠোন। তবে তুলসী গাছ ক্ষুদ্র পরিসরে লাগানো সম্ভব। বারান্দায় অথবা জানালার কোনে তুলসী রাখা যায়। আহামরি যত্ন না নিলেও তুলসী বেড়ে উঠে। ২০২০ ও ২০২১ সালে টানা দুইবার বায়ুদূষণে তালিকায় প্রথম হয় ঢাকা। অন্তত ঘরর বায়ুকে পরিস্কার রাখতে গাছের বিকল্প নেই। খুব সাধারণ কিছু বিষয় মেনে ঘরেই তুলসী লাগানো সম্ভব। 

চারা সংগ্রহ ও টব বাছাই

সরাসরি বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যায় তবে কাছের নার্সারি থেকে পুষ্ট চারা সংগ্রহ করাই ভালো হবে। টব এর উচ্চতা ৮-১০ ইঞ্চি হতে হবে। এতে চারাগুলো শিকড় ভালোভাবে বৃদ্ধি পাবে। 

মাটি তৈরি 

তুলসী সব মাটিতেই ভালো জন্মে। এর বিশেষ পছন্দ লোনা মাটি। টবের মাটি তৈরির ক্ষেত্রে ১ ভাগ নদীর বেলে মাটি, ১ ভাগ দো-আঁশ মাটি, ১ ভাগ জৈবসার ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর টবে প্রস্তুতকৃত মাটি ভরতে হবে। টবের মাটি প্রস্তুত হলে এতে গাছটি রোপন করতে হবে। টবে অবশ্যই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা জরুরি। চারা রোপন শেষে এতে পর্যপ্ত পরিমাণ পানি দিতে হবে। 

পরিচর্যা

তুলসী গাছে খুব বেশি আলোর প্রয়োজন হয় না। দিনে ৪ ঘন্টা আলো পেলেই চলে। বাকী সময় ছায়াতে থাকতে সক্ষম। এমন জায়গায় তুলসী রাখতে হবে যেখানে মুটামুটি আলো পড়ে। তুলসী গাছে অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন হয় মা। মাটির আদ্রতা কমে গেলে পরিমিত পানি ঢালুন। প্রতিমাসে অন্তত একবার একমুঠো সরিষার খৈল, টিসপি আধা চা চামচ ডিএপি আধা চা চামচ করে টবের মাটিতে মিশিয়ে দেবেন। তুলসী মুটামুটি রোগবালাই মুক্ত উদ্ভিদ তবে মাঝেমধ্যে পোকা তুলসী গাছের ক্ষতি সাধন করে। পোকার আক্রমন থেকে বাঁচাতে এক চামচ নিম ওয়েল ও এক চিমটি ডিটার্জেন্ট একলিটার পানিতে মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত তিনবার স্প্রে করলে পোকার আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষা করা যায়। গাছকে ঝোপ বানাতে চাইলে গাছে মুকুল আসার সাথে সাথে কেটে দেবেন এতে গাছ ঝোপওয়ালা ও সুগঠিত হবে। 

তুলসীর যত গুনাগুন 

তুলসীর রয়েছে আশ্চর্য ঔষধি গুন। বহুকাল থেকে রোগ নিয়ন্ত্রণে ও নিরাময়ে তুলসীর ব্যবহার হয়ে আসছে। ঠান্ডা, কাশি থেকে শুরু করে ফুসফুস, কিডনি এমনকি ত্বকের লবন্যতা বাড়াতে তুলসী উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদ। আজ এর ঔষধি গুনাগুন ক্রমান্বয়ে আলোচনা করবো। 

পেটে ক্ষুধা অথচ খেতে পারছেন না, মুখে অরুচি। প্রতিদিন সকালে খালিপেটে কয়েকটি তুলসী পাতা চিবিয়ে খান। রুচি ফিরে আসবে। 

ঠান্ডা কাশিতে আদার রসের সাথে অথবা মধুর সাথে তুলসী পাতার রস মিশিয়ে খান। এতে ঠান্ডা কাশি কমবে। 

তুলসী পাতায় থাকে ভিটামিন সি, ফাইট্রোনিউট্রিয়েন্টস, অ্যাসেনসিয়াল ওয়েল যা আপনার ত্বকের জন্য উপকারি। তুলসী পাতা, নিমপাতা, মুলতানি মাটি চন্দন, লবঙ্গ কর্পূর ফেসপ্যাক বানিয়ে মুখে লাগাতে পারেন। এতে ব্রণের সমস্যা দূর হবে, ত্বকে আসবে লাবন্যতা, ত্বকে সহজে বার্ধক্যের ছাপ পড়বে না। 

বেসনের সাথে তুলসীপাতা মিশিয়ে ফেসপ্যাক বানিয়ে ত্বকে লাগালে দাগ দূর হয়। 

তুলসীতে অ্যান্টি-আক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকে যা দেহ থেকে টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। ফলে ডিহাইড্রেশন ও কিডনির সমস্যা দূর হয়। তাছাড়া কিডনির পাথর হওয়া প্রতিহত করে। 

মুখে দুর্গন্ধ, কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে কয়েকটি তুলসী পাতা পানিতে সেদ্ধ করে পান করুন। মুখে দুর্গন্ধ দূর করার পাশাপাশি আপনার গলা পরিস্কার করবে। 

জ্বর অনুভূত হলে, দিনে দুইবার তুলসী পাতার রস পান করুন। জ্বর দ্রুত কমবে। 

তুলসী পাতার চা ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। স্বাস্থ্য সচেতন অনেকেই এই হার্বাল টি পান করছে। এই চা পানের ফলে মানসিক অবস্বাদ দূর হয়। মস্তিষ্কের রক্তচলাচল স্বাভাবিক করে, শারিরীক ক্লান্তি দূর করে। 

শরীর ব্যথায় বা মাথা ব্যথায় তুলসীর রস সেবন করলে দ্রুত উপশম পাওয়া যায়। 

চোখ ব্যথা, চোখ লাল হওয়া, চোখের পাপড়ি ফুলে গেলে তুলসি পানিতে মিশিয়ে সেই পানি দিয়ে নিয়মিত চোখ ধুতে হবে। এতে চোখের সমস্যা দূর হবে। 

বুকে কফ জমলে তুলসী পাতার রস খেতে পারেন। এতে কফ কমবে। 

তুলসী পাতায় রয়েছে ভিটামিন সি, অ্যান্টি ইনফ্লেমটরি, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। যা আপনার স্নায়ুবিক চাপকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত হবে। তাই নিয়মিত এই পাতা খান। 

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় হাপানি, ফুসফুসের সমস্যা, ব্রঙ্কাইটিস প্রতিরোধে তুলসী কর্যকরি। 

তুলসী ও এলাচ একত্রে ফুটন্ত পানিতে ফুটালে এর নির্যাস পানির সাথে মিশে যায়, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। 

আপনার শরীরের ক্ষতস্থান শুকাতে তুলসী পাতার পেস্ট ব্যবহার করুন, ক্ষতস্থান দ্রুত শুকাবে। 

রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে তুলসী সহায়ক ভুমিকা রাখে। রক্তের কলস্টরেল নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে শরীরের বাড়তি চর্বি কমে শরীরকে সুগঠিত করে। 

তুলসী পাতায় থাকা রেডিওপ্রোটেকটিভ উপাদান ক্যান্সারের জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম। এটি টিউমারে থাকা কোষকে  মেরে ফেলে। ফলে ক্যান্সার প্রতিহত হয়। 

হৃদরোগ বা হার্টের অ্যাটাকে প্রতিরোধে তুলসী কাজ করে। 

পেট খারাপ হলে, পেটে আলসার থাকলে বা গ্যাসের সমস্যায়, তুলসী পাতা মিশ্রিত গরম পানি পান করুন। পেটের যেকোনো সমস্যায় এটি দারুণ কর্যকর। 

তুলসী গাছ ও হিন্দু মিথোলজি

তুলসী গাছের সাথে হিন্দুধর্মের সম্পর্ক বিদ্যমান। এটি হিন্দুমতে পবিত্র উদ্ভিদ। তুলসীকে লক্ষ্মীর অবতার ও বিষ্ণুর সহধর্মিণী বিবেচনা করা হয়। বিশ্বাস করা হয় তুলসী গাছে শুভশক্তি থাকে। তুলসী যে মাটিতে জন্মে সেই মাটিকেও পবিত্র বলে মনে করা হয়। যে নিয়মিত তুলসী পূজা করে সেই ঘরে সুখ,শান্তি বিদ্যমান থাকে হঠাৎ কোন শোকের খবর সেই ঘরে আসে না। তুলসী পাতা দিয়ে  নারায়ণ পূজা করলে  জীবনে কোনদিন কোন কষ্ট থাকবে না যদি কোন পাপ করে থাকেন তার প্রায়শ্চিত্ত হবে এই তুলসীপাতা দিয়ে। সন্ধ্যেবেলা তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালালে আপনি বৈষ্ণব পদ লাভ করতে পারবেন। শ্রীমদ্ভাগবতে অন্যান্য গাছের তুলনায় তুলসীর গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে:

যদিও মন্দার, কুণ্ড, কুরবাক, উতপালা, ক্যাম্পাক, আরন, পুন্নাগ, নাগকেশারা, বকুলা, লিলি এবং পরিজাতের মতো ফুল গাছগুলি অত্যাধিক সুগন্ধে পরিপূর্ণ, তবুও তারা তুলসীর দ্বারা করা তপস্যা সম্পর্কে সচেতনপ্রভুর দ্বারা বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যিনি নিজেকে তুলসী পাতা দিয়ে মালা দেন।

— শ্রীমদ্ভাগবত, পর্ব ৪, অধ্যায় ১৫, শ্লোক ১

তুলসী অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়। এর আশপাশে মুত্রত্যাগ বা ব্যবহার করা পানি ফেলা নিষেধ। তুলসী গাছ মারা গেলে একে উপড়ে ফেলা যাবে না বা কাটাও যাবে না। গাছটি একেবারে শুকিয়ে গেলে ধর্মীয় আচারের সাথে জলাশয়ের পানিতে বিসর্জন দিতে হয়। 

তুলসী আমাদের দেশে সর্বত্র কমবেশি জন্মে। এর ব্যপক ব্যবহার রয়েছে। তুলসীর এত গুনাগুন যা আপনার ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি আপনার পরিবারের সুস্বাস্থ্যের দায়িত্ব নেবে। যাঁরা বাসায় বাগান করেন বা ইনডোর প্লান্টে আগ্রহী তারা অন্যান্য গাছের পাশাপাশি তুলসীকে অবশ্যই প্রাধান্য দেবেন। 

1 thought on “তুলসী গাছের কথা”

  1. অনেক তথ্যবহুল আলোচনা। ধন্যবাদ আদিপ্রাণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *