ফুল কার না ভালো লাগে, ফুল মনকে দেয় প্রশান্তি৷ পৃথিবীতে আছে বাহারি রকমের ফুল। একেক ফুলের একেক বৈশিষ্ট্য। আপরাজিতা ফ্যাবেসি প্রজাতির ফুল। আপনার বেলকুনিতে এই গাছ শোভাবর্ধক হিসেবে কাজ করে। বেলকুনিতে লতানো সবুজের সাথে নীল ফুল সত্যিই অসাধারণ। আপনার বাসা কিংবা বেলকুনিতে রাখুন অপরাজিতা। যা আপনাকে অক্সিজেন দেওয়ার পাশাপাশি ওষধি সেবাও করবে।
আপরাজিতা বহুবর্ষজীবী জাতীয় উদ্ভিদ। এটি আমাদের দেশীয় ফুল। ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, অস্টেলিয়া, আফ্রিকায় এই ফুল জন্মে। উদ্ভিদটি প্রাকৃতিক নাইট্রোজেন আবদ্ধ করতে সক্ষম। গাছটির শিকড়ে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া গুলি বাতাসের নাইট্রোজেনকে সংগ্রহ করে।
গাছের বিবরণ
আপরাজিতা গাছ লম্বায় বেশ বড় হয়। এর সবুজ পাতার মাঝে সুন্দর ফুলটি দেখা যায়। এটি লতানো উদ্ভিদ। আমাদের দেশে সাধারণত সাদা ও নীল অপরাজিতা পাওয়া যায়।
রোপন, মাটি ও সার প্রয়োগ
অনেকে বাসার ছাদে, ঘরের উঠানে বা বারান্দায় অপরাজিতা রোপন করে থাকে। আপরাজিতা গাছের বেড়ে উঠার জন্য পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর প্রয়োজন হয়, তাই বারান্দায় রোপনের ক্ষেত্রে আলো পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে। গাছের ডাল কেটে বা বীজ রোপন করে এর বংশবিস্তার সম্ভব।বীজ রোপনের ক্ষেত্রে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। এই গাছ মাটিতে লাগানোর আদর্শ সময় বর্ষাকাল।
মনে রাখতে হবে অপরাজিতার বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কম, তাই অধিক পুষ্ট বীজ বাছাই করতে হবে। সবসময় পরিপুষ্ট বীজ বাছাই করবেন। এসব ক্ষেত্রে বীজের রঙ গাঢ বাদামী ও এর আকার গোলাকার শক্ত আকৃতির হবে। পানিতে পরীক্ষা করতে পারেন, প্রথমে এক গ্লাস পানিতে বেশকিছু বীজ ১৫-২০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। গাছ জন্মানোর উপযুক্ত বীজগুলো পানিতে ভেসে উঠবে।
যাচাই বাছাই করে সেখান থেকে ভালো মানের বীজ নির্বাচন করবেন। টবে গাছ রোপনের জন্য কমপক্ষে ছয়ইঞ্চি গভীর টব নির্বাচন করবেন, এতে গাছে শিকড় ভালোভাবে বাড়তে পারে। আপনার টব বা বাগানে ভেজানো বীজ এক ইঞ্চি পরিমাণ গভীর এবং কমপক্ষে চার থেকে ছয় ইঞ্চি দূরে দূরে রোপণ করার চেষ্টা করুন। রোপনের পর আপনাকে মাসখানেক ধৈর্য ধরতে হবে। এই সময়টাতে মাটিকে আদ্র রাখতে চেষ্টা করুন। চারাগুলিতে তিনটি পাতা দেখা গেলে তা রোপনের জন্য প্রস্তুত। অথবা বীজতলাতেই সেগুলো রাখতে পারেন। আপরাজিতার মূল সংবেদনশীল তাই চারা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে মূলের যাতে ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
গাছের জন্য উত্তম মাটি দো-আঁশ, তবে মুটামুটি উর্বর এমন মাটিতেও অপরাজিতা ভালো জন্মে। তবে গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেদিকে লক্ষ রাখতে। অতিরিক্ত পানির জন্য এর পাতা হলুদ হয়ে ঝড়ে পড়ে। মাটির আদ্রতায় খেয়াল রাখুন। মাটিতে হাতের আঙ্গুল দিয়ে আদ্রতা পরীক্ষা করুন। শুকনা মনে হলে পরিমিত পানি ঢালুন। টবের ক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখুন। ৫-৬ কেজি মাটিতে ৩ কেজি কম্পোস্ট সার নিন, এতে ৩০০ গ্রাম স্টেরামিল ভালোমতো মিশিয়ে নিন। এই মাটি গাছ জন্মানোর জন্য উপযুক্ত। অপারাজিতা জৈবসার খুব পছন্দ করে। সপ্তাহে একদিন সরিসার খৈল ব্যবহার করতে পারেন।
আলো ও তাপমাত্রা
অপারাজিতা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের উদ্ভিদ। তাই একে পর্যাপ্ত আলো পায় এমন জায়গায় রাখতে হবে। রোদে এই উদ্ভিদে সানন্দে বেড়ে উঠে। তবে এই গাছ কিছুটা ছায়ার মাঝেও বেড়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে ফুল কম ফুটবে। গাছটি লতানো হওয়ায় এটি লম্বায় ১০ ফুট এবং পাশে ২ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। টবে গাছটিকে ঝুলিয়ে রাখা যেতে পারে।
তাপমাত্রার কথায় আসলে গাছটি সর্বোচ্চ ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে। তাপমাত্রা এর বেশি হলে গাছটি বেঁচে থাকতে পারবে না।
অপারাজিতা ফুল অনেক প্রাচীন। এর রয়েছে বহুমুখী উপকারিতা। ঠিকমতো যত্ন নিলে সারাবছর অপরাজিতা ফুল ফোঁটে। নীল ও সাদা অপারাজিতা আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়। নীল অপারাজিতা সাদা অপারাজিতা তুলনায় দ্রুত বর্ধনশীল।
অপরাজিতার যত গুন
এই ফুল যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি এর রয়েছে নানান ঔষধি গুন। এই গাছ প্রাচীনকাল থেকে ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অপরাজিতার ফুল, পাপড়ি, মূল দিয়ে ভেষজ ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। হিন্দু ধর্মালম্বীদের এই গাছ পবিত্র। দেবী দূর্গার অপর নাম অপরাজিতা। তাই দূর্গাপুজায় ষষ্ঠী ও দশমীতে এর ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। অপরাজিতায় রয়েছে অধিক মাত্রায় ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস। ফলে এর ঔষুধি গুণাবলীও অনেক।
লিভারের সুরক্ষায়
অপরাজিতার নীল চা পলিফেনল ও ফ্লাভোনোয়েড যৌগ লিভার এনজাইমের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। ফলে লিভার থাকে সুস্থ সবল।
চোখের রোগ
চোখ খচখচ করলে, চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়লে, চোখ জ্বালাপোড়ায় নীল অপরাজিতা খুব কর্যকরি। কয়েকটি নীল অপারাজিতা বেটে চোখে প্রোলেপ দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, প্রয়োজনে একধিকবার ব্যবহার করুন। আপনি চোখের সমস্যা থেকে আরোগ্য লাভ করবেন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি ডায়বেটিস এর অন্যতম কারণ। অপরাজিতা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যার ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে কাজ করে।
বাত
বাতের ব্যথার রোগী প্রায়শই দেখা যায়। ৫০০ মিলিগ্রাম অপরাজিতার শিকড় পানি দিয়ে বেটে খেলে বাতের ব্যথার নিরাময় হয়।
অ্যাজমা প্রতিরোধ
স্যাপোনিন ও ফ্লাভোনোয়িড যৌগ অ্যাজমা প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অপরাজিতা ফুলে উক্ত যৌগ পাওয়া যায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য
যাঁরা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভুগছেন তারা ২ গ্রাম পরিমাণ অপরাজিতার বিচি গুড়ো করে গরম দুধে মিশিয়ে খেলে উপকার পাবেন। এটি রাতের খাবার পর খাবেন।
ক্যান্সার প্রতিরোধ
অপরাজিতায় রয়েছে অ্যান্থোসায়ানিন, এটি আমাদের দেহে ফ্রি রেডিক্যাল তৈরি করতে দেয় না। ফলে এটি ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
স্মৃতিশক্তি বাড়ায়
আপরাজিতা স্মৃতিশক্তি বাড়ায়, যারা দ্রুত ভুলে যায় তাদের চিকিৎসায় অপারাজিতা ব্যবহার করা হয়।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
মানব দেহে রক্তের মাঝে ট্রাইগ্লিসারাইডস, কোলেস্টেরল ও এলডিএলের বিদ্যমান। উক্ত উপাদান নিয়ন্ত্রণে অপরাজিতা সহায়ক ভুমিকা রাখে। ফলে অনেকাংশে হৃদরোগ এর ঝুঁকি কমায়।
অপরাজিতা ফুলের চা
দিনদিন জনপ্রিয় পানিয়তে পরিনত হচ্ছে অপরাজিতা ফুলের চা। এই চা পুরোপুরি ক্যাফেইন মুক্ত প্রাকৃতিক চা। সরাসরি ফুলের নির্জায থেকে চা প্রস্তুত করা হয়। এই চা ব্লু টি নামে পরিচিত।
চা তৈরি
গরম পানিতে অপরাজিতা ফুলকে ফুটিয়ে এই নীল চা প্রস্তুত করা হয়। এক্ষেত্রে ফুলের পাপড়ি পানিতে ডুবিয়ে এর সমস্ত নির্জাস বের করে নেওয়া হয়। অম্ল ও ক্ষারের উপর ভিত্তি করে এই চা রঙ বদলাতে সক্ষম। স্বাদ বাড়াতে এতে লেবুর প্রয়োগ করা যায়, লেবু দিলে এই চা বেগুনি রঙ ধারণ করে। স্বাদের জন্য এতে চিনি প্রয়োগ করা যায়। তবে যাঁরা ডায়বেটিস এর রোগি তারা চিনি ছাড়া এই চা পান করবেন। ঠান্ডা বা গরম উভয় অবস্থাতেই এই চা খাওয়া যায়।
এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইটোকেমিক্যালস। এছাড়াও এতে পলিফেনল, ফ্লাভোনোয়িডস, স্যাপোনিন, ট্যানিন, অ্যান্থোসায়ানিন, অ্যালকালোয়িডস, টারনাটিনস, ইনোসিটল ও পেন্টান্যাল ইত্যাদি রয়েছে। যা মানবদেহের জন্য বেশ উপকারি। এই হারবাল চা অবশ্যই আমাদের পান করা উচিৎ।
আপরাজিতা যেমন সুন্দর উদ্ভিদ ঠিক তেমনি এর ভেষজ গুনাবলী। খুব অল্প পরিচর্যার এই গাছ বেড়ে উঠে। এটি ঘরের শোভাবর্ধন এর পশাপাশি আপনাকে বিভিন্ন রোগবালাই থেকে রক্ষা করবে। এমন সহজলভ্য দেশি প্রজাতির গাছ আমাদের অবশ্যই সংগ্রহে রাখা দরকার।