নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় ক্রমশই কমে যাচ্ছে সবুজ। নগরের মানুষের মাঝে সবুজের আকুতি বেড়েই চলছে। আর তাদের জন্য অসাধারণ পন্থা হতে পারে ঘরে বনসাই প্রতিপালন। গাছ মানসিক চাপ কমায়। বনসাই বা বামন গাছ এক ধরণের জীবন্ত ভাস্কর্য। আভিজাত্যে পরিপূর্ণ এই উদ্ভিদ সহজেই ঘরে রাখা যায়। এতে বেশ উপকারও আছে।
রয়েছে। বনসাইয়ের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে চীনে এর চর্চা শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে অন্যান্য দেশে বনসাই ছড়িয়ে পড়ে।
এখনকার সময়ে শৈখিন মানুষ ঘরের ইন্টেরিয়র হিসেবে বনসাইয়ের ব্যবহার করে। গাছের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে অগভীর পাত্রে সেই গাছের ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে বনসাই। ঘরে বনসাই রাখতে হলে বনসাই সম্পর্কে জানতে হবে ও এর পরিচর্যার ব্যাপারে আগ্রহী হতে হবে। আজ তাই বনসাই নিয়ে আলোচনা করবো।
ইতিহাস
প্রাচীন মিশরে ৪০০০ খ্রিস্ট পূর্ব অব্দে টবে গাছ লাগানোর বিষয়টি জানা যায়। প্রাচীন ভারতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। চীনের নানা জায়গা, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কোরিয়ার বনসাই উৎপাদনের কেন্দ্র বলে বিবেচিত। ২৬৫ থেকে ৪২০ খ্রিস্টাব্দের চিনের ছং রাজবংশের সময় টবে গাছ লাগানোর প্রচলন শুরু হয়। এসময় নানান পন্থায় তারা গাছ লাগানো শুরু করে। এই গাছগুলোকে তৎকালীন সময়ে হাচি-নো-কি বলা হত। এমনকি সেই সময় জাপানী পুরোহিত কোকান শিরেন এর বনসাই নিয়ে একটি গদ্য বই পাওয়া যায়। যাতে বাগান পরিকল্পনা ও পরিচর্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
প্রাচীন তাও ধর্মালম্বীরা মনে করতেন, ক্ষুদ্র গাছের মধ্যে অতিপ্রাকৃত শক্তি জমা থাকে। আর মানুষের হাতে তৈরি এসব ক্ষুদ্র উদ্ভিদে জগৎ ও প্রাণিকুলের জন্য শান্তি নিহিত রয়েছে। জাপানিরাই প্রথম বনসাই দিয়ে ঘর সাজানোর প্রথা শুরু করে। তখনকার ধনীদের মধ্যে বনসাই পালন জনপ্রিয় হয়ে উঠে। অবসরে এটা তাদের এক বিনোদনের মাধ্যমে হয়ে যায়। যদিও ধারণা করা হয় জাপানিরা চীনাদের কাছ থেকে বনসাই তৈরির ধারণা রপ্ত করেছে৷
গাছ নির্বাচন
বনসাই করতে গেলে প্রথমে গাছ নির্বাচন করতে হবে। আমাদের দেশে ভালো বনসাই হতে পারে এমন কিছু গাছ হলো বট বকুল, শিমুল, পাকুড়, তেঁতুল, শিরিষ, বাবলা, পলাশ, বিলিতি বেল, ছাতিম, হিজল, জাম, নিম, বেলি, গাব,শেফালী, পেয়ারা, হেওরা, ডালিম, তমাল, জাম্বুরা, কমলা, তুলসী, বহেরা, বরই, কামিনী, মেহেদী,কড়ই, অর্জুন, জারুল, জুনিপার, নরশিংধ, করমচা, লুকলুকি,কৃষ্ণচূড়া, কদবেল, দেবদারু, সাইকেশ, হরিতকী,কামরাঙা, আমলকি, নীলজবা, লালজবা,অশ্বথ বট, নুডা বট, পাকুর বট, কাঠালি বট, রঙ্গন ছোট, রঙ্গন বড়, নিম, সুন্দরী, লাল গোলাপ, খই বাবলা, কনকচাঁপা, গোলাপজাম, পাথরকুচি, সাদা নয়নতারা, স্টার কুইন, বাগানবিলাস, হেলিকুনিয়া, লাল টাইমফুল, গোলাপিটা ফুল, ক্যাকটাস গোল,ক্যাকটাস লম্বা, পান বিলাস, লালা পাতাবাহার,লাল জামরুল, চায়না বাঁশ, সন্ধ্যা মালতী, হলুদ, যজ্ঞ ডুমুর ও আলমন্ডা। এই গাছগুলোর বৃদ্ধি আস্তে আস্তে হয়। এদের কান্ড মোটা হয়। বছরে কমপক্ষে একবার পাতা ঝরে। একটি বনসাইয়ে এসব বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরি। বনসাই করা অনেকটা সাধনা করার মতো। কয়েকমাস বা কয়েকবছর লেগে যায় একটি বনসাই করতে। সবচেয়ে ভালো হয় আপনি বাজার থেকে বনসাই কিনে ঘরে রাখলে। এতে সময় ও শ্রম লাগে না।
মাটি তৈরি ও সার প্রয়োগ
যেকোনো গাছের ক্ষেত্রে মাটি নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদর্শ মাটিতে আদর্শ গাছ। বনসাই অবশ্যই আপনাকে টবে লাগাতে হবে। এর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মাটি হচ্ছে দো-আঁশ মাটি। এতে কম্পোস্ট সার, হাড়ের গুড়া, ইটের গুড়া, গোবর সার মেশাতে হবে। বেশ কিছুদিন গাছটিকে টবে পালনের পর একে ট্রেতে আনতে হবে। ট্রে অবশ্যই ঘনত্বের দিক থেকে পাতলা হবে। ট্রে এর মাটিতে হাড়ের গুড়া ১০%, ছোটো পাথর ২০%, পোড়ামাটি ২০%, ককোপিট ২০%, গোবর সার ২০%, ছাই ও মোটাবালি ১০% মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নিতে হবে। এভাবে আদর্শ মাটিতে গাছের সুন্দর রঙ আসবে, ফুল ও ফল জন্মাবে।
টব বা পাত্র
বনসাই প্রথমে টবে কয়েকবছর পালন করতে হয়। এরপর ট্রে জাতীয় পাত্রে স্থানান্তর করতে হবে। যেখানেই রাখা হোক পাত্রটি যথেষ্ট পরিস্কার রাখা জরুরি। চাইলে গাছের সাথে মানানসই ভারসাম্যপূর্ণ পাত্র ব্যবহার করতে হবে। বনসাইয়ের পাত্রে পানি জমতে দেওয়া যাবে না, এতে মশা বা ক্ষতিকারক পোকার জন্ম হতে পারে।
রোপন
যে কোনো ঋতুতেই বনসাই করা যায়। তবে বর্ষাকাল এর জন্য আদর্শ সময়। এই সময় বাতাসের আদ্রতা গাছের জন্য বেশ উপকারি।
কাটিং ও তার পেচানো
বনসাইকে বেশি বড় হতে দেওয়া যাবে না। যতটা বেটে রাখা সম্ভব ততই ভালো। শুরুর দিকে এর পত্রমুকুল ভেঙ্গে দিতে হবে। এতে নিচের পাতার অংশ বাড়তে বাধ্য হবে, ফলে গাছটি ছোটো হলেও ঝোঁপের আকৃতি নেবে। গাছের জোড়া পাতার অংশ থেকে সাধারণত দুটি শাখা হয়। এর যেকোনো একটি রাখতে হবে। একটিকে ডানদিকে রাখলে নিচেরটি বামদিকে রাখতে হবে। শাখা থাকবে শুধুমাত্র ডান ও বাম দিকে এবং পেছনের কাণ্ডের দিকে। সামনের দিকে এর কোনো শাখা থাকবে না।
একটি বনসাইয়ের নির্দিষ্ট সময় পর এর প্রুনিং বা ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন। ৩-৪ বছর বয়স হলেই এর ছাঁটাই করতে হবে। কনভেন কাটিং প্লায়ারস নামে কাটিং প্লাস ব্যবহার করে এর প্রুনিং করবেন। সাধারণ কাচি ব্যবহার করা যাবে না। বনসাইয়ের জন্য বিশেষ কিছু যন্ত্রপাতি রয়েছে, সেগুলোই ব্যবহার করতে হবে।
বড় গাছে ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে বনসাই। বনসাই আলাদা কোনো গাছ নয়। এতে সমগোত্রীয় বড়গাছের সব গুনাগুন অক্ষুণ্ণ থাকে। কাণ্ড ডালপালা সু-বিন্যাস্ত, সুঠাম করতে তার পেচানো অন্যতম মাধ্যম। তামার তার ব্যবহার করা উত্তম। তবে গ্যালভালাইজিং করা ধাতব অন্যান্য তার ব্যবহার করা যাবে। কাণ্ডের জন্য মোটা তার আর ডালের জন্য চিকন তার ব্যবহার করতে হবে। তার পেচালে গাছ বেশ নাজুক অবস্থায় থাকে। তার খোলার পর সপ্তাহখানেক গাছটিকে ছায়ায় রাখতে হবে।
যত্ন
বনসাই ঘরে থাকে ফলে আলোর তীব্রতা পায় না। অপর্যাপ্ত আলো বনসাই বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এতে পাতা কমে যেতে পারে ফলে পাতার ছাঁটাই ব্যহত হয়। শীতকালেও আলোর পরিমান অপর্যাপ্ত থাকে। এই সময়টাতে গাছটিকে দক্ষিণ জানালার পাশে রাখুন। এতে গাছ আলো ও হাওয়া পাবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করুন। প্রতিদিন ১০-১২ ঘন্টা বনসাইলে এলইডি বাতির নিচে রাখুন। বৈদুতিক আলো থেকেও বনসাই তার চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
রুম হিটার বা এয়ার কন্ডিশনার বনসাইয়ের জন্য ক্ষতিকারক। আদ্রতা বজায় রাখতে রুমের জানালা খুলে রাখুন। কৃত্রিমভাবে আদ্রতা বজায় রাখতে চাইলে ঘরে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন।
ঘরের অভ্যন্তরে বেড়ে উঠা বনসাইয়ের জন্য খুব বেশি সার, পানির প্রয়োজন হয় না। পরিমাণ মতো জৈবসার ব্যবহার করুন। ঘনঘন পানি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। মাটিতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে দেখুন মাটির আদ্রতা ঠিক আছে কীনা। আদ্রতা কম থাকতে পরিমিত পানি ঢালুন।
কেন বনসাই রাখবেন
- বনসাই একটি সুন্দর উদ্ভিদ, যা আপনার রুচিবোধকে উপস্থাপন করে।
- এটি মানসিক স্টেস কময়।
- ঘরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ায়।
- মনকে প্রশান্ত করে তোলে।
- বাতাসের দূষণ কমিয়ে পরিশুদ্ধ বায়ুতে রুপান্তর করে।
- বনসাই সুস্থ স্বাস্থ্যকর জীবনের প্রতীক।
- বনসাই মানুষের ধৈর্যশক্তি বাড়ায়।
- ঘর ও অফিসের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে।
বনসাই অনেকদিন বাঁচে। কথিত আছে সবচেয়ে পুরোনো বনসাইয়ের বয়স ৮০০ বছর। বছরের পর বছর আপনার সাথে থাকতে থাকতে বনসাই আপনার পরিবারের সদস্যের মতো হয়ে যাবে। ছোট্ট সবুজ বনসাই হোক আপনার প্রিয় বন্ধু। বেডরুম থেকে শুরু করে সমগ্র পৃথিবী হয়ে উঠুক সবুজের অভয়ারণ্য।