দিনদিন সবকিছু যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে, অতিরিক্ত নগরায়ন আমাদেরকে সবুজ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই ঘরের সাজসজ্জা সবুজের মাঝে হলে সবচেয়ে ভালো হয়। সবুজে আছে অনবদ্য প্রশান্তি। মনস্টেরা ঘর সজানোর অভিজাত ইনডোর প্লান্ট।
এর পাতাগুলো বেশ নান্দনিক। দেখলে মনে হয় কোনো শিল্পী তার মনের মাধুরি মিশিয়ে গাছের পাতাগুলো কেটে দিয়েছে৷ প্রতিটি প্রাণের জন্যই আলাদা আলাদা যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ, মনস্টেরাও এর বিপরীত নয়। সাধারণ কিছু বিষয় মাথায় রাখলের ঘরে রাখতে পারবেন প্রাণবন্ত মনস্টেরা।
পরিচয়
মনস্টেরা গরমকালের উদ্ভিদ, এরা লিয়ানা অ্যারয়েড পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এর আদি জন্ম ব্রাজিল ও মেক্সিকো অঞ্চলে। পরবর্তীতে মনস্টেরাকে ভারতীয় উপমহাদেশে আনা হয় এবং এখানে ধীরে ধীরে স্থায়ী হয়। মনস্টেরা লম্বায় প্রায় ২০ মিটার বড় হতে পারে। এর পাতাগুলো ৯০ সেমি পর্যন্ত বড় হয়ে থাকে। ইনডোরে পালনের জন্য মনস্টেরা বেশ উপযোগী একটি গাছ। যথাযথ যত্ন পেলে এই গাছ ফুল ফোঁটে এমনকি ফলও পাওয়া যায়, ফলটি পাকতে কয়েকমাস সময় লাগে স্বাদটা অনারসের মতো হয়। এই ফল প্রথম বছর খাওয়া যায় না, তখন ফলটি বিষাক্ত থাকে। তবে দ্বিতীয় বছর থেকে নিশ্চিন্তে খেতে পাওয়া যাবে। সবুজের অনবদ্য প্রশান্তি পেতে ঘরে রাখুন মনস্টেরা।
জায়গা নির্বাচন
ইনডোর প্লান্টের জন্য জায়গা নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আলো-বাতাস সহজেই যাতায়াত করে এমন জায়গা মনস্টেরা গাছের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আলোর মাঝে গাছ বেশ সুন্দরভাবে উপস্থাপন হয়। তবে আপনি চাইলে আপনার পছন্দসই যেকোনো জায়গায় গাছ রাখতে পারবেন। জায়গাটি অন্ধকার হলেও সমস্যা নেই। এজন্য আপনাকে সপ্তাহে অন্তত একবার গাছকে সূর্যের আলোর কাছাকাছি জায়গায় রাখতে হবে। সোফার পাশে, বেডরুমে, বেলকুনিতে মনস্টেরা রাখতে পারেন। আপনার ঘরে আনবে সবুজের প্রশান্তি।
মাটি তৈরি
মনস্টেরার রোপনের জন্য বিশেষভাবে মাটি তৈরি করতে হবে। প্রথমেই যদি ভালো করে মাটি তৈরি করে গাছ রোপন করা হয় তবে সার দেওয়ার তেমন প্রয়োজন পরে না। এর জন্য খুব হালকা মাটি তৈরি করতে হবে। তাই ৫০% ককোপিট নিতে হবে। ককোপিট পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়। ২৫% ঝুরঝুরে গার্ডেন সয়েল নিতে হবে, প্রয়োজনে চালনি দিয়ে চেলে নিতে হবে। ২৫% নিতে হবে কম্পোস্ট সার। গোবর কম্পোস্ট, পাতা কম্পোস্ট যেকোনো কম্পোস্ট হলেই হলো। এরপর ৬-৮ ইঞ্চি টবের জন্য মাটির মুল উপাদানের পাশাপাশি ১ চা চামচ হলুদ গুড়া, হাড়ের গুড়ার পাউডার ১ চা চামচ, নিম খৈল টব প্রতি ২ চা চামচ মিশিয়ে মাটি তৈরি করে ৭-৮ দিন রেখে দিতে হবে, ফলে মাটিতে সার খুব সহজেই রিলিজ হয়ে যাবে। এরপর গাছ লাগালে ৩-৪ মাস তেমন কোনো খাবার বা সার প্রয়োজন হবে না, ককোপিট থাকার জন্য খুব বেশি পানিরও প্রয়োজন হবে না।
মনস্টেরার বীজ সংরক্ষণ করা যায় না তাই বীজ সংগ্রহের পরপরই ১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। বীজ কিছুটা ফুলে উঠলে মাটিতে রোপন করতে পারবেন। তখন মাটিকে অবশ্যই কিছুটা আদ্র রাখতে হবে।
গাছের আদর্শ বৃদ্ধি
আপনার মনস্টেরা কতটা বৃদ্ধি পাবে তা আলো ও পানির উপর নির্ভরশীল। পর্যাপ্ত আলো বা ঘরের বৈদুতিক আলোয় পানির সামঞ্জস্যতায় মনস্টেরা বছরে ১-২ ফিট বৃদ্ধি পায়। এর প্রকৃতিক বৃদ্ধি, লম্বার চেয়ে চওড়া বেশি হবে।
সূর্যরশ্মি
সরাসরি সূর্যরশ্মি মনস্টেরার জন্য ভালো না। সূর্যের সরাসরি তাপ গাছের পাতাকে রোগাক্রান্ত করে ফেলে। আপনি ঘরের যেকোনো জায়গায় মনস্টেরা রাখতে পারবেন। অল্প আলো বা বৈদুতিক বাতির আলোতে এর গ্রোথ ভালো হয়। প্রকৃতির হালকা আলোর মাঝেও এই গাছ শোভা বাড়ায়। তবে সরাসরি সূর্যতাপে গাছকে রাখা যাবে না।
পানি প্রয়োগ
পানি ইনডোর প্লান্টের প্রাণ। নির্দিষ্ট পরিমাণ মাপি গাছকে সতেজ করে। অন্যদিকে অতিরিক্ত পানি বা পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা না থাকলে গাছের গোড়া পচে মারাও যেতে পারে। মাটির উপরিভাগ শুকিয়ে গেলে সপ্তাহে অন্তত দুইবার পানি দিতে হবে। মাটির উপরিভাগে পানি জমে থাকলে তা অপসারণ করতে হবে। নইলে যেমন গাছের ক্ষতি হবে তেমনি মশা জন্মনোর ঘরে পরিণত হবে।
পাতার যত্ন
২০২০-২১-এ সবচেয়ে জনপ্রিয় ইন্ডোর প্লান্ট মনস্টেরা। বড় বড় পাতার মনস্টেরার পাতা ইনটেরিয়র ডিজাইনারের পছন্দের শীর্ষে। এই গাছের ডাল কেটে বসালেই গাছ বেড়ে উঠতে সক্ষম। গাছ রোপনের প্রথমদিকে পাতার পূর্ণাঙ্গ সৌন্দর্য ফুটে উঠে না। এই গাছের পাতায় ধুলা লেগে থাকলে দেখতে ভালো খারাপ লাগে। তাছাড়া পাতার রয়েছে অসংখ্যক ছিদ্র যা দিয়ে গাছ তার বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করে। গাছে তাই নিয়মিত পানি স্প্রে করা প্রয়োজন। তাছাড়া মাঝেমধ্যে পাতা পাতলা সুতি কাপাড় ভিজিয়ে মুছে নিতে পারেন। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে মনস্টেরার পাতা গৃহপালিত পশুর জন্য ক্ষতিকর। কুকুর,বিড়াল অথবা অন্যকোনো পশু এই পাতা খেলে পেটে যন্ত্রণা হয় এমনকি বমি করতে পারে। তাই গৃহপালিত পশু হতে মনস্টেরা সাবধানে রাখতে হবে।
ঘরের আবহাওয়া
মনস্টেরার জন্য ঘরের আবহাওয়া ও তাপমাত্রায় নজরদারি করতে হবে। মনস্টেরার জন্য উপযুক্ত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। ২০-২৫ ডিগ্রী তাপ আদর্শ। অতিরিক্ত তাপে একে রাখা যাবে না। সরাসরি সূর্যালোকে এর পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং ঝরে পড়ে। এতে গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কাটিং
মনস্টেরা কাটিং করে খুব সহজেই এর বংশ বিস্তার করানো যায়। মনস্টেরা অ্যাডানশন বেশ লতানো উদ্ভিদ, খুব সহজেই এরা উপরে উঠে যায়, এর জন্য স্টিক ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কাংঙ্খিত সাইজের জন্য অবশ্যই আপনাকে গাছকে ছেঁটে দিতে হবে। একটি ডালের গোড়ার দিকে এর কাটিং করতে হবে। কাটিং পানিতে রাখলে কয়েকদিন এর মাথায় দেখবেন এর গোড়ায় শিকড় গজাতে শুরু করেছে। এরপর এই কাটি মাটিতে লাগাবেন। অথবা কেউ চাইলে কাটিং সরাসরি মাটিতে লাগাতে পারেন ৭-৮ দিনের মাথায় এর ফল পেতে শুরু করবেন। কাটিং এর পর গাছকে অবশ্যই ছায়াতে রাখবেন।
গাছের খাদ্য
পরিপুষ্ট গাছের জন্য চাই যুতসই খাদ্য। আলো পানি ছাড়াও গাছের বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধের জন্য খাদ্য অপরিহার্য। রোপনের সময় সঠিকভাবে মাটি প্রস্তুত করলেও কিছুদিন পর এর খাদ্য প্রয়োজন হবে। অন্তত তিনমাস পরপর গাছে বোরন সার খাদ্য হিসেবে দেবেন। ছত্রাকের আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষা করতে প্রতিমাসে একবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করুন।
সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে রোপন করতে পারলে এই গাছ আপনার ঘরকে করে তুলবে সবুজের অপ্সরি। মানুষ মুগ্ধ হবে এই দৈতাকার গাছটি দেখে। আপনাকে করবে আরও রুচিশীল । ঘর হয়ে উঠবে এক টুকরো সবুজ উদ্যান। ঘরে বাড়াবে অক্সিজেন। আপনি ও আপনার পরিবার হবে উদ্যমী। অন্যান্য ইনডোর প্লান্ট থেকে মনস্টেরা অনেকটাই বৈচিত্র্যময়।
আপনি নতুন হলে, আপনার ঘরে ইনডোর প্লান্ট রাখতে চাইলে তালিকায় অবশ্যই মনস্টেরা রাখুন। এই গাছ আপনাকে মুগ্ধ করবেই।