‘বাগান অনেক শিক্ষার্থীর আয়ের উৎস হতে পারে’

নায়য়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজর উপজেলা এলাকার ছেলে শাহপরান। গাছকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসেন। মাত্র ৫ বছর বয়সে মায়ের কাছ থেকে উপহার পাওয়া গাছ থেকে শুরু তার বাগান করা। বর্তমানে এই তরুণের সংগ্রহে রয়েছে হাজারের অধিক গাছ। গাছের প্রতি অদম্য আগ্রহ থাকায় পড়াশোনা করছেন অ্যাগ্রিকালচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, নারায়ণগঞ্জে।

তার বাগান করার অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন সময়ে সংগৃহীত গাছ ও সেগুলোর পরিচর্যা নিয়ে কথা বলেছেন আদিপ্রাণের সাথে। বাগানের প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা ও গাছ সম্পর্কিত  বিভিন্ন বিষয়ে খুটিনাটি আদিপ্রাণকে জানান। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন অদিপ্রাণের কনটেন্ট ম্যানেজার আশরাফ আল যায়েদ।

আদিপ্রাণ: বাগান করার চিন্তা আপনার কবে থেকে শুরু?

শাহপরান: সত্যি বলতে, বাগান করতে হবে এমন কোনো চিন্তাই ছিলো না। ছোট থেকেই গাছ ভালো লাগে তাই বাগান করা। যখন আমার বয়স ৫ বছর তখন আমার মা আমাকে একটি ‘সকাল সন্ধ্যা’ গাছ এনে দেন। এরপর থেকে আমি নিজেই গাছ রোপণ করি। এ যেন অনবদ্য এক প্রশান্তি। ধীরে ধীরে আমার নেশায় পরিনত হয়ে যায়। এখন গাছের প্রেমে এতটাই ডুবে গেছি গেছি, গাছ ছাড়া আমার অস্তিত্বই কল্পনা করতে পারি না।

আদিপ্রাণ: আপনার বাগানে তো বাহারি গাছ রয়েছে এগুলো কোথায় থেকে সংগ্রহ করেছেন?

শাহপরান: প্রথমদিকে আশপাশের নার্সারি থেকে সংগ্রহ করতাম।   তারপর ধীরে ধীরে অনলাইন প্লাটফর্মের কথা জানতে পারি। একটি নার্সারিতে আপনি সবধরনের গাছ পাবেন না। অনলাইনে গাছের প্রচুর ভ্যারাইটির রয়েছে। তাই এখন অনলাইন থেকে বেশি গাছ কেনা হয়।

আদিপ্রাণ: আপনি কোথায় গাছ রোপন করতে বেশি ভালোবাসেন, ইনডোর নাকি আউটডোরে?

শাহপরান: আমি অভারঅল সব রকম জায়গাতেই গাছ রোপণ করি। গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে আমি জানি। ইনডোর বলুন আর আউটডোর বলুন সবখানেই সবুজের প্রশান্তি ভালোলাগে। তাছাড়া প্রতিদিনের জীবনে গাছের অবদান কিন্তু কম নয়।

আদিপ্রাণ: তুলনামূলক কোন ধরনের গাছ এখানে বেশি?

শাহপরান: আমার বাগানে সব ধরনের গাছই আছে। ক্যাকটাস, সাকুলেন্ট, পাথোস, ক্যালাডিয়াম, অর্কিড, বনসাই, কডেক্স প্লান্ট, জলজ গাছ, ঔষধি গাছ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ফল গাছ বেশি রয়েছে।

আদিপ্রাণ: ফুল, ফল নাকি ঔষধি কোন গাছ থেকে বেশি উপকৃত হন?

শাহপরান: অবশ্যই ঔষধি গাছ থেকে বেশি উপকৃত হই। ভেষজে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না।  অন্যান্য গাছও আমাদের উপকার করে তবে ঔষধি গাছ আমাদের বেশি উপকার করে।

আদিপ্রাণ: আপনার বাগানের ক্যাকটাস ও সাকুলেন্টের যত্নে কী করেন?

শাহপরান: ক্যাকটাস ও সাকুলেন্ট এর প্রধান বিষয় হচ্ছে রোদ আর পানির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। ক্যাকটাসের ৬-৭ ঘন্টা কড়া রোদ প্রয়োজন। সেই অনুযায়ী ক্যাকটাস গুলো রেখেছি আর সাকুলেন্ট রেখেছি যেখানে সকাল বেলার রোদ পায় এমন জায়গায়। ৩-৪ দিন পর পর নিয়মিত পানি দেই। আর ১৫ দিন পরপর ছত্রাকনাশক স্প্রে করি।

আদিপ্রাণ: বাগান করার জন্য কী ধরণের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন?

শাহপরান: সাধারণ ভাবে বাগান করার জন্য প্রথমে মাটি খোড়ার কোদাল, গাছে পানি দেওয়ার জন্য পানির পাত্র এগুলোই জরুরি। বাগানের গাছ অনুযায়ী যন্ত্রপাতির দরকার হয়। প্রুনার, ট্রোয়েল, কাচি, হ্যান্ড গ্লাভস, স্প্রেয়ার অবশ্যই একজন আধুনিক বাগানির নিকট থাকা দরকার।

আদিপ্রাণ: আপনার বাগানের গাছগুলো বেশ স্বাস্থ্যবান। গাছের জন্য মাটি প্রস্তুত কী ধাপ অনুসরণ করেন?

শাহপরান: একেক ধরণের গাছের জন্য একেক ধরনের মাটি তৈরি করি। ফুল ও ফল গাছের জন্য দোআঁশ মাটি ৬০ ভাগ, জৈব সার ৩০ ভাগ আর বাকি পাচ ভাগ কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, হাড়ের গুড়া ও রাসায়নিক সার ( TSP & MOP) সার। ক্যাকটাসের ও সাকুলেন্ট এর জন্য লাল বালি,কয়লা, জৈব সার, ধানের চিটা, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক এবং হাড়ের গুড়া দেই।

আদিপ্রাণ: কোন গাছগুলোর বানিজ্যিক উৎপাদন করা সম্ভব? 

শাহপরান: প্রায় সব ধরনের গাছই বানিজ্যিক ভাবে উৎপাদন করা যায়। বর্তমানে গাছের প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে। বেড়েছে সৌখিন বাগানিদের সংখ্যা।

আদিপ্রাণ: আপনার বাগানে থাকা কিছু রেয়ার গাছের নাম বলুন?

শাহপরান: মন্সটেরা ডুবিয়া, মন্সটেরা ডেলিসিওসা এলবো ভেরিগেটেট, রাফিডোফেরা হাই, কয়েক ধরনের এলোকেশিয়া, কয়েক ধরেনর ফিলোডেনড্রোন, ক্যালাডিয়াম, থাই ভ্যারাইটির আঙ্গুর, অগ্নি সাগর কলা, আপেল ইত্যাদি।

আদিপ্রাণ: আপনিতো একজন শিক্ষার্থী,  “বাগান করা ব্যয়বহুল” এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

শাহপরান: বাগানের জন্য অনেক খরচ এটা বলা ঠিক না। গাছ অনুযায়ী খরচ। দামি গাছ বা রেয়ার গাছ গুলোর কেয়ার বেশি করতে হয়। অন্যান্য গাছের জন্য এতো খরচ করা লাগে না। আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি কয়েকটা টিউশন করাই। সেখান থেকে জমানো টাকা দিয়ে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি গাছ কিনি। টুকটাক গাছ সেল করি তাই তা দিয়েও বাগানের খরচ চালিয়ে নিতে পারি।

আদিপ্রাণ: বাগান করে কী আয় করা যায়? সেটা কীভাবে?

শাহপরান: বাণিজ্যিকভাবে বাগান করে সেখান থেকে উৎপাদিত ফল, ফুল বিক্রি করে আয় করা একটা উপায়। আর আমার মতো শখের বাগানিরা বাগানের অতিরিক্ত গাছ বিক্রি করে আয় করতে পারেন। আরেকটি উপায় হলো মাতৃ গাছ থেকে চারা তৈরি বা কলম করে বিক্রি করা একটা মাদার প্লান্ট থেকে অনেকগুলো চারা পাওয়া সম্ভব। বাগান করা শিক্ষার্থীদের জন্য সব দিক থেকেই বেশ উপকারি। পড়াশোনার পাশাপাশি বাগান অনেক শিক্ষার্থীর আয়ের উৎস হতে পারে।

শাহপরান

আদিপ্রাণ: আপনার বাগানের কোন গাছগুলো বেশি রোগাক্রান্ত হয়? 

শাহপরান: আমি ১৫ দিন পর পর কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করি। তাই আমার কোন গাছেই কোনো রোগ হয় না।

আদিপ্রাণ: ইনডোর প্লান্ট নাকি ছাদবাগানের যত্ন বেশি করতে হয়?

শাহপরান: যত্ন ছাড়া কোন জিনিস ভালো থাকে না। সব গাছের জন্যই যত্ন আবশ্যক। তবে ইনডোর গাছ একটু সেনসেটিভ, তাই তুলমূলক বেশি খেয়াল রাখতে হয়।

আদিপ্রাণ: এমন হয়েছে কখনো পছন্দসই গাছ সংগ্রহ করতে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন? 

শাহপরান: আমি যেহেতু একজন স্টুডেন্ট, অনেক গাছই আছে যা পছন্দ হয়েছে কিন্তুু অর্থের অভাবে কিনতে পারি নাই। আপনি যখন নিজে বাগান করবেন ও গাছের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়াতে থাকবেন তখন বিষয়টা বুঝবেন। গাছের জগৎটা অনেক বড়, প্রচুর দামী গাছ রয়েছে। এগুলো দেখতেও লোভনীয়। 

আদিপ্রাণ: পরিবার আপনার বাগান করার বিষয়টা কীভাবে দেখে? 

শাহপরান: প্রথম প্রথম পছন্দ করতো না, বকতো। বকাবকি করার পরেও যখন দেখে কোনো কাজ হয় না, তাই এখন আর কিছু বলে না।

আদিপ্রাণ: আপনার বাগান কী কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো? 

শাহপরান: আমি আমার বাগানের গাছগুলোর ব্যাপারে খুব সচেতন ও যত্নশীল। তাই বাগানকে কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেই নাই।

আদিপ্রাণ: আপনি বাসায় না থাকলে বাগানের যত্ন কী পদক্ষেপ  নেন?

শাহপরান: আমি বাগানের জন্য দূরে কোথাও বেড়াতে বা ঘুরতে যাই না। আর গেলেও গাছে পানি দিয়ে যাই।

আদিপ্রাণ: অনেকেই দেখি বাগানে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে বাগানিদের কী ধরণের সার ব্যবহার করতে পারবে?

শাহপরান: গাছের জন্য জৈব সার সবচেয়ে ভালো। তবে জৈব সারের পাশাপাশি রাসায়নিক সার অল্প ব্যবহার করলে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

আদিপ্রাণ: আপনার বাগানের সবচেয়ে পুরনো গাছ কোনটি?

শাহপরান: একটা গোলাপ গাছ। বাগান করার শুরুর সময়ে এটি সংগ্রহ করেছিলাম। এখনও বেশ ভালোই আছে।

আদিপ্রাণ: গাছ নিয়ে কোন বিশেষ স্মৃতি থাকলে বলুন।

শাহপরান: গাছ নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে। এত স্মৃতিকথা বলেই শেষ করা যাবে না। তবে গাছকে কেন্দ্র করেই পরিচিত হয়েছি অনেকের সঙ্গে। গাছের জন্য অনেক ভালো কিছু মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে।

আদিপ্রাণ: আপনার প্রিয় কিছু গাছের নাম বলুন।

শাহপরান: সব গাছই আমার প্রিয়। তাই নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। 

আদিপ্রাণ: প্রিয়জনকে উপহার দেওয়া যায় এমন কিছু গাছের নাম বলুন।

শাহপরান: প্রিয়জনকে উপহার দেওয়া যায় এমন গাছ যা সেই মানুষটার উপকারে আসবে। চাইলে  বিভিন্ন প্রকার ফল ও ঔষধি গাছ দেওয়া যায়।

আদিপ্রাণ: এখন তো বর্ষাকাল চলছে বর্ষায় গাছের আলাদা কী ধরণের যত্ন লাগে।

শাহপরান: গাছের গোড়ায় আগাছা জমতে দেওয়া যাবে না। টবে বা মাটিতে যেখানেই হোক গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে। বর্ষায় সময় মতো গাছের গোড়ার মাটি খুচিয়ে দিতে হবে। এছাড়া গাছের শিকড় পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আদিপ্রাণ: “অর্থ নাকি শখ” বাগান করতে কোনটার প্রয়োজন বেশি বলে আপনি মনে করেন।

শাহপরান: কথায় আছে, ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। তেমনি আপনার যদি বাগান করতে চান সেটা কোনো না কোনো ভাবে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

আদিপ্রাণ: পড়াশোনার চাপে বাগানের জন্য কীভাবে আলাদা সময় দেন?

শাহপরান: বাগানে নির্দিষ্ট করে সময় দিতে পারি না। নিজের পড়ালেখা ও অন্যান্য কাজের ফাকে যতটুকু সময় পাই তখন বাগানে কাজ করি।

আদিপ্রাণ: আপনার বাগান নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

শাহপরান: বাগানটাকে আরও বড় পরিসরে গড়ে তোলা, পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে বৃক্ষপ্রেম ছড়িয়ে দেওয়া।

আদিপ্রান: নতুন যারা বাগান করতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে কী বলতে চান?

শাহপরান: কোনকিছুই সহজ নয়, চাই ইচ্ছাশক্তি।  বাগান করতে গিয়ে অনেক সময় অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তখন হাল ছেড়ে দিলে হবে না। ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। সফলতা আসবেই।

আদিপ্রাণ: বাগন নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদানের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহপরান: আদিপ্রাণকেও অনেক ধন্যবাদ।

শাহপরানের বাগান (ফটো গ্যালারি)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *