গিলিয়াম ফার্ডিনার, একজন শহুরে কৃষক। ছয় বছর হলো প্যারিসে বসবাস করছেন। যান্ত্রিকতায় পরিপূর্ণ ফ্রান্সের রাজধানীতে তিনি নিজের খামারে উৎপাদিত বিট, গাজরসহ অন্যান্য তাজা সবজির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। আদিনিবাস ফ্রান্সের উত্তর দিকের একটি গ্রাম ভার্টনে তাদের পারিবারিক খামারের কীটনাশকমুক্ত ও টাটকা ফল-ফসল প্যারিসের মতো জায়গায় নেই। তিনি বুঝতে পারেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য একটি আধুনিক, টেকসই ও বৈচিত্র্যময় কৃষিব্যবস্থার বিকল্প নেই।
ফার্ডিনার আরও একজন উদ্যোক্তাকে সাথে নিয়ে ২০১৫ সালে এগ্রিকুল নামে এক শহুরে খামার প্রতিষ্ঠা করেন। খামারটির কৃষকরা নিয়মিত কাজ করে ৬০টির বেশি সুপার মার্কেটে কিটনাশকমুক্ত লেটুস, স্ট্রবেরি ও অন্যান্য সবজি সরবরাহ করছেন।
ফ্রিল্যান্স লেখক ডালিয়া সিংগার’র লেখা এক নিবন্ধে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে শহুরে কৃষির ভবিষ্যতের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। ‘How to grow food in a concrete jungle’ শিরোনামে বিবিসিতে প্রকাশিত লেখাটির অনুবাদ করা হয়েছে এখানে। লেখাটি বাংলাদেশ সাপেক্ষে শহুরে কৃষি সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক ভাবনার খোরাক তৈরি করবে বলে আশা রাখছি।
গ্রামে উৎপাদন ব্যবস্থা ভালো থাকায় শাক সবজিসহ অন্যান্য অনেক ফসল বেশ সহজলভ্য। সবুজ-সতেজ ফল এবং তাজা শাক-সবজি গ্রামের সর্বত্রই যা স্বাদ এবং পুষ্টিগুণে অনন্য। প্যারিসে স্থানীয় উৎপাদন বলতে কিছু নেই বললেই চলে। এখানে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভালো হলেও নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা না থাকাটা একটি প্রধান সমস্যা যা মানুষের জীবনযাত্রায় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।
‘ভার্টিক্যাল ফার্মিং’ মডেলে তৈরি এগ্রিকুলের মতো খামারগুলো শহরকেন্দ্রিক চাষাবাদের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গা বা ছাদে বাগান করার শখ অনেকেরই। খালি জায়গার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে খামারগুলো সবুজ সবজির চাহিদা অনেকাংশেই পূরণ করছে। অনেক শহরের পাশে বা একেবারে কেন্দ্রে কৃষিকাজের এমন ধারণা নতুন কিছু নয়। তবে নিরাপদ এবং সতেজ খাবারের চাহিদার কারণে প্যারিসের মতো জায়গায় কৃষি খামার গড়ে তোলার মতো উদ্যোগ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার নানা পরিবর্তনের ফলে অনেক মানুষই উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। যে সকল ভোক্তারা যারা আগে কৃষিকাজের সাথে যুক্ত ছিলেন, তারা এখন আর সরাসরি যুক্ত নেই। তবে অনেকেই তাদের কাছে সরবরাহকৃত ফসল ও খাবার কোথায় এবং কিভাবে উৎপাদিত হচ্ছে সেই বিষয়ে কৌতূহলী হচ্ছেন।
বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস থেকে নাইজেরিয়া সর্বত্রই কৃষি উদ্যোক্তারা নতুনভাবে ভাবছেন কিভাবে স্বল্প পরিসরে টেকসই প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা যায়। তারা প্রচলিত খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের ত্রুটিগুলো সংশোধনের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছেন। কার্যত, কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণের পর বিদ্যমান খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যাগুলো আরও সামনে চলে এসেছে।
অনুমান করা যায়, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ১০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে এবং শতকরা ৬৮ জন শহরের অধিবাসী হবেন। ফলে, আমাদের অধিক খাদ্য উৎপাদনের কথা ভাবতে হবে যাতে গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। ভোক্তার চাহিদা এবং উৎপাদনের দূরত্ব কমিয়ে আনার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা আরও নিশ্চিত করা যায় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হলে জনস্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তারও অবসান ঘটবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মোট খামারের ১৫ শতাংশ শহর এবং শহরের আশেপাশে অবস্থিত। এগুলোর মধ্যে ওহিও থেকে পরিচালিত ‘৮০ একর ফার্ম‘ নামের একটি খামার কোনোপ্রকার কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই দেশটির ৪টি অঙ্গরাজ্যের ৮টি স্থানে ফসল উৎপাদন করে আসছে। তাদের প্রক্রিয়ার অন্য অনেক খামারের চেয়ে থেকে শতকরা ৯৭ ভাগ কম পানি ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির দুই প্রতিষ্ঠাতা মাইক জেলকিন্ড এবং টিসা লিভিংস্টোন এটিকে একটি মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের ইন্ড্রাস্টিতে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা উৎপাদন বাড়াতে ক্রমাগত নতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তি পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন।
এখন পর্যন্ত এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিকভাবে সহজে উৎপাদন করা যায় এমন ফসলের দিকে নজর দিলেও জেলকিন্ড এবং লিভিংস্টোন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মরিচ, টমেটো এবং শসার মতো ফসলও উৎপাদন করতে পেরেছেন।
জেলকিন্ড জানান, খামারের মোট ৮০ একর জমি পুরো বছর জুড়েই ব্যবহৃত হয়। জমিগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সময়ভেদে আলাদা আলাদা শস্য রোপণ ও কাটা হয়। আধুনিক এবং উন্নত প্রযুক্তিই কম জায়গায় অধিক খাদ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা এবং ঘরোয়া পরিবেশে কৃষিকাজকে কার্যকরী এবং সহজলভ্য করছে। তাদের এই খামার অন্যান্য খামারের তুলনায় ৩শ থেকে ৪শ গুণ বেশি ফলদায়ক বলেও দাবি তার।
জেলকিন্ড আরও জানান, ১০ বছর আগে এটি ছিল একটি কাল্পনিক গল্পের মতো। এই ৮০ একর জায়গায় বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদনের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে নেদারল্যান্ডভিত্তিক কৃষি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান প্রিভা হোল্ডিং বিভি এবং যুক্তরাজ্যের অনলাইন গ্রোসারি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওকাদো’র একসাথে পথচলা। তারা উন্নত প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের ইনডোর ফার্ম গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেছ।
অন্যদিকে ‘এগ্রিকুল’ খামারটিও ভার্টিক্যাল গ্রোয়িং সিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল। ফার্ডিনার জানান, তাদের গ্রিনহাউজ ১২০গুণ বেশি ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম যেখানে অন্যান্য গ্রিনহাউজ খামারগুলো ১৫গুণ বেশি ক্ষমতা সক্ষম।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- শহুরে জায়গায় তৈরি করা ফার্ম কি ভবিষ্যতের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত খাবার উৎপাদনে সক্ষম কি না? জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র খামার প্রকল্পের পরিচালক আনু রংরাজন বলেন, একক খাদ্য শৃঙ্খলের উপর নির্ভর করে ভবিষ্যতের প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে না। বরং, একাধিক খাদ্য শৃঙ্খলের মিশেলে একটি পরিপূর্ণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সরবরাহ নিশ্চিত সম্ভব। একটি ছোট জায়গায় শাক-সবজি বা ফলমূল হতে পারে কিন্তু ক্যালরি প্রদায়ক শস্য উৎপাদনের জন্য অবশ্যই বড় পরিসর প্রয়োজন।
সম্প্রতি এগ্রিপলিস নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্যারিস এক্সপোতে ‘ন্যাচার আরবান ফার্ম’ প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। অ্যারোফোনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বহুতল ভবনের ছাদে বাগানে করে তাতে টমেটো, স্ট্রবেরি এবং বেগুন উৎপাদন করছে। এক্সপোতে সরবরাহকৃত প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, তাদের শক্তিমত্তা মাত্র এক তৃতীয়াংশ এখন পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। তারা এমন ২০টি বাগানে প্রতিদিন ১.১ টনের বেশি ৩৫ ধরণের শস্য উৎপাদনে সক্ষম বলে জানানো হয় এক্সপোতে।
এগ্রিপলিস প্রতিষ্ঠাতা পেসক্যাল হার্ডি তাদের ব্যবহৃত কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে বলেন, এটি নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচন করেছে। নতুন এই প্রযুক্তি যথেষ্ট সম্ভাবনাময়, এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্ত ভিত্তি সম্পন্ন। আমরা মনে করি না আমাদের এই শহুরে কৃষি পদ্ধতি শহরে বসবাসকারী সব মানুষের খাদ্যের যোগান দেওয়া সম্ভব হবে। তবে এটি প্রচলিত কৃষির সাথে নতুন একটি সংযোজন বলে মনে করেন তিনি।
এরকম আরও একটি প্রতিষ্ঠান সাইক্লোফোনিক্স, যারা প্রায় ৬শ হেক্টর গাড়ি পার্ক করার জায়গায় প্রোটিনসমৃদ্ধ মাশরুম উৎপাদন করছে। একইসাথে তারা উদ্ভাবনী খাদ্য উদ্যোক্তাদের জন্য জায়গাও সরবরাহ করছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী তাপ প্রকৌশলী জেন-নোয়েল গার্তেজ বলেন, মানুষ ভালো এবং পুষ্টিকর খাবারের সন্ধান করে। একইসাথে এই খাবারে উৎস সম্পর্কেও তারা জানতে চায়। আমরা তাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর তৈরি করছি মাত্র।
সাইক্লোফোনিক্স এখন দিনে ১শ কেজির বেশি মাশরুম উৎপাদনে সক্ষম মাত্র ৩৮হাজার বর্গফুট জায়গার মধ্যে। এই উৎপাদন গাড়ি পার্কিংয়ের মোট জায়গার মাত্র শূন্য দশমিক এক শতাংশ।
সবকিছুই আশাব্যঞ্জক হলেও কিছু জটিলতা এখনও রয়েই গেছে। জমির জোগান, শ্রমিকের দক্ষতা এবং কাজের সমন্বয়ই এখন পর্যন্ত প্রধান সমস্যা বলে চিহ্নিত করা গেছে।
প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে কানাডার ব্রিটিশ কলোম্বিয়া রাজ্যের ভিক্টোরিয়াতে গড়ে ওঠা আরও একটি কৃষি খামার টপসয়েল ইনোভেটিভ আরবান এগ্রিকালচার ফার্ম। ফার্মটির প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস হিল্ডরেথ বলেন, একটি কৃষি উদ্যোগকে টেকসই এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা যায় সহজেই। প্রযুক্তি, পরিকল্পনা এবং দক্ষ লোকবলসম্পন্ন উদ্যোগই সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
এ ধরণের কৃষি উদ্যোগের ফলাফল শুধুমাত্র শারীরিক পুষ্টি সরবরাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শহুরে খামারগুলো কাজ এবং কৃষি বিষয়ক শিক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এটি যেমন আমাদের দৈনন্দিন খাবারের পুষ্টিমানের নিশ্চয়তা দিবে, তেমনি জলবায়ুর বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাহায্য করবে।
শুধু উদ্যোক্তা নয়, শহরকেন্দ্রিক কৃষির বিকাশে ভোক্তাদেরও কিছু দায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে। উৎপাদিত ফসল বা শস্য ক্রয়ের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে পারে। উদ্যোগগুলোর প্রচার এবং প্রসারের ক্ষেত্রেও ভোক্তারা অবদান রাখতে পারে।
বর্তমানে ক্যালোরি চাহিদার শতকরা মাত্র ২ শতাংশ আসে সাগর থেকে যার অধিকাংশই আসে মাছ থেকে। সাও পাওলো, সাংহাই এবং নিউ ইয়র্কসহ বিশ্বের বড় শহরগুলোর মধ্যে আটটিই সাগরতীরে অবস্থিত। ইংল্যান্ডের নাগরিক জন হোমইয়ার্ড দীর্ঘদিন থেকেই মাছ ব্যবসার সাথে জড়িত। তিনি অনেক আগে থেকেই প্রোটিনের বিকল্প উৎস খোঁজা নিয়ে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে ঝিনুক একটি টেকসই বিকল্প হিসেবে কাজে আসতে পারে বলে মনে করেন।
বিশ্বজুড়ে শহুরে কৃষির নানা ধরণ এবং প্রকারভেদ রয়েছে। এই সবগুলোকে একটি বলয়ের মধ্যে আত্তীকরণ করা গেলে একটি শক্তিশালী খাদ্য শৃঙ্খল তৈরি করা সম্ভব। প্রযুক্তিগত আরও উন্নয়ন এবং সৃষ্টিশীল মানুষের অবদানের ফলে শহুরে কৃষিকে বিকল্প খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে খাদ্যের প্রধান উৎসে পরিণত করা সম্ভব।