খ্রীস্টপূর্ব ২০০০-৪০০ বছর আগে সভ্যতার জন্মস্থান মেসোপটোমিয়া তে ছাদ বাগানের উদ্ভাবন হয়। ‘ব্যাবিলনের শুন্য উদ্যান’ থেকে ঐতিহাসিক পম্পেই নগরী হয়ে ইতালি তারপর মেডিসন স্কয়ার গার্ডেন (নিউইয়র্ক) ছাদ বাগানের সহস্র বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের পরিচায়ক। শুধুমাত্র একটি সুবিশাল ছাদ বাগানের কারনেই নিউইয়র্কের ‘মেডিসন স্কয়ার’ নামটির পর ‘গার্ডেন’ শব্দটি যুক্ত হয়, যা ছাদ বাগানের জনপ্রিয়তা ও ভালোবাসার পরিমাপক।
তদুর্যপুরি এযুগে হঠাৎ করে ব্যাবিলনের শুণ্য উদ্যানের মৃত কঙ্কাল আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে, বাগান শুধু করাই কি যথেষ্ট? সেটি রক্ষা করা কি যঠেষ্টই দুরহ?
ঠিক তেমনি একটি বাগান তৈরির পরিকল্পনা করলে, তার সাথে সাথে কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। যেমন:
- ছাদে বাগান করা যাবে তো?
- ছাদ ড্যাম হয়ে পড়বে না তো?
- ভবনের ক্ষতি হবে নাতো?
- ছাদ বাগান তৈরি করতে খরচ কেমন?
এমন নানান প্রশ্নের উত্তর ও সমাধান নিয়েই এই লেখা। আদিপ্রানের এই নিবন্ধে আপনাদের বাগান শুরুর প্রাথমিক ৭ অপরিহার্য বিষয়ে দিক নির্দেশনার চেষ্টা করা হয়েছে যা ছাদবাগান তৈরির আগে আপনার জন্য সহায়ক হবে।
১. ছাদের লোড নির্ণয়
লোড ক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের ছাদ বাগান আপনার ভবনের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারন হতে পারে। কারন স্বাভাবিক ছাদ বাগান ভেজা থাকলে তার ওজন কয়েক গুন বেড়ে যেয়। তাই সঠিক ভাবে বিল্ডিং লোড নির্ণয় করা পরিকল্পিত বাগান তৈরির প্রথম ও প্রধান শর্ত।
ছাদ বাগান করার পূর্বেই প্রকৌশলী কর্তৃক ছাদের লোড মাপাতে হবে। এতে ছাদ কি পরিমান ওজন বহন করতে পারবে তা জানা যাবে। এরপর কাঙ্খিত বাগানের সকল গাছ ও মাটির সম্মিলিত ওজন নির্নয় পূর্বক ড্রাম ও টবের পরিমান ঠিক করতে হবে। বাগানের ওজন ধারনার ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, তা যেনো অবশ্যই মাটি ভেজা অবস্থায় যাচাই করা হয়।
বাগানের ওজন অবশ্যই ছাদের লোডিং ক্ষমতার নিচে রাখতে হবে। প্রয়োজনে বাগানের ধরন পরিবর্তন করে বা ড্রামের আকার ছোট করতে হবে। তবে যেকোন ছাদেই ছোট বা বড় পরিসরে বাগান করা সম্ভব।
২. ড্যাম্পপ্রুফ/সিজনিং/ওয়াটার রেজিসট্যান্ট করা
ছাদ বাগানে সরবরাহকৃত পানি চুইয়ে ছাদে শ্যাওলা তৈরি করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে পানি পড়তে পড়তে ছাদ ড্যাম্প হয়ে যেতে পারে। ছাদ ড্যাম্প হলে এতে লোনা ধরে। দেয়ালের রঙ খসে পরে ও আস্তর নষ্ট হবার ভয় থাকে। এজন্য অবশ্যই ছাদ বাগান তৈরির পূর্বে ছাদকে ড্যাম্পপ্রুফ বা ওয়াটারপ্রুফ এবং ছাদের পানি নিষ্কাশনের সহজ রাস্তা করতে হবে।
ভিন্টেজ বাগানের ক্ষেত্রে ছাদের উপরের পৃষ্ঠের ওয়াটার প্রুফ মেমব্রেন ব্যবহার করা উত্তম। মেমব্রেনের উপরের রুট প্রটেক্টর অতিরিক্ত পানি ড্রেনেজের মিডিয়া হিসেবে কাজ করে।
আধুনিক ছাদ বাগানের ক্ষেত্রে রং এর মাধ্যামে ওয়াটার প্রুফ করা যায়, আবার আলকাতরার পুরু স্তর দিয়েও ছাদ লোনা ধরার হাত থেকে বাঁচানো যায়। বৃষ্টি ও টব বা ড্রামের অতিরিক্ত পানি থেকে রং ছাদের কনক্রিটকে রক্ষা করবে ও ছাদ ভেজা থাকবে না। আবার পুরু আলকাতরা ছাদের উপর পানি নিরোধক আবরণ হিসেবে কাজ করবে ও সবসময় ছাদকে শুকনো রাখবে। স্থায়ী বেডের ক্ষেত্রে আলকাতরা ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম খরুচে।
ছাদ বাগানের ড্রাম ইট বা লোহার রিং এর উপর উচু করে রাখা যায়। এতে টবের নিচের অংশে বাতাস চলাচলে শুকনো থাকবে ও ছাদ স্যাতেস্যাতে হবার ভয় থাকবে না।
৩. পরিকল্পনা ও বাজেট তৈরি
যেহেতু ছাদে আপনি আনলিমিটেড গাছ লাগাতে পারবেন না, সেহেতু কি জাতের গাছ, কতটি, কিভাবে রোপন করবেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত প্ল্যান তৈরি করা উচিত। বাগানের আকার, গাছের জাত অনুযায়ী ১৫ হাজার থেকে শুরু করে কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে। বাজেটের ভিত্তিতে পরিসর ছোট বা বড় করে বাগান করা সম্ভব।
আপনি চাইলে ড্রাম, টব বা স্থায়ী বেডেও বাগানের পরিকল্পনা করতে পারেন। স্থায়ী বেড ছাদ থেকে উচু করে তৈরি করা যেতে পারে যা বহু বর্ষজীবী গাছ পালনের ক্ষেত্রে উপযোগী হবে। স্থায়ী বেড খরুচে হলেও টব ও ক্যারেট থেকে দীর্ঘস্থায়ী। আবার ড্রাম স্থায়ী বেডের তুলনায় সাশ্রয়ী এবং টব, ক্যারেট অপেক্ষা বেশ দীর্ঘস্থায়ী।
ড্রামে ফল গাছ ভালো হয় আর টব ফুল ও অন্যান্য শোভাবর্ধক গাছের জন্য ভালো। গাছের দাম তার জাত, প্রাপ্যতা ও সাইজের উপর নির্ভর করে। তাই ছাদ বাগান তৈরির পূর্বেই কি পরিমান গাছ কিভাবে রোপন করা হবে তার বিস্তারিত পরিকল্পনা করা আবশ্যকীয়।
অনেকেই ছাদে জলাধার ও ফোয়ারার কনসেপ্ট পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের নিমিত্তে পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে। জলাধার আপনার ছাদ বাগানের খরচ খানিকটা বাড়ালেও, সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে কয়েকগুন।
৪. আলো ও ছায়া পরিমাপ
ছাদ বাগান করতে চাইলে পূর্ব শর্ত হলো আলো। সূর্যালোক ছাড়া সব গাছ বাঁচতে পারে না। আবার কিছু গাছ উজ্জ্বল আলোতে ভালো হয় না, বরং দিনে মিনিমাম আলো পেলেই ভালো থাকে। তাই ছাদ বাগান তৈরির পূর্বেই আপনার ছাদে কোথায় কি পরিমান রোদ আসে তা পর্যবেক্ষন করতে হবে।
ছায়ায় বড় হয় এমন গাছ ছাদের ছায়াযুক্ত স্থানের জন্য নির্বাচন করুন। বীজতলার জন্যও ছায়াযুক্ত সবচেয়ে আদর্শ স্থান। আবার কিছু সবজি আংশিক ছায়ায় ভালো হয়। এদের জন্য আংশিক ছায়াযুক্ত স্থান নির্বাচন করুন।
যদি ছাদের আশেপাশে বহুতল ভবন না থাকে তাহলে ছাদে উজ্জল রোদ থাকার কথা। সে ক্ষেত্রে গ্রীষ্মের তীব্র রোদ আপনার গাছের ক্ষতি করতে পারে। এমতাবস্থায় আপনি চাইলে ছাদ থেকে উচু করে নেটের ছাউনি দিতে পারেন। ফলে তীব্র রোদ আপনার গাছের ক্ষতি করতে পারবে না। আবার ছাদকে রোদের তীব্র উত্তাপ থেকে রক্ষা করবে।
৫. বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ
আপনি যদি ওয়াসার পানি সেবা ব্যবহার করতে চান তবে মাথায় রাখা উচিত তা ক্লোরিনযুক্ত হতে পারে। পানির অণুতে ক্লোরিন বেশি থাকলে তা ভারি পানি হিসেবে পরিচিত হয়। এ ধরনের পানি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়াশে ব্যবহার করলেও জীব জগতের জন্য ক্ষতিকর। তাই ছাদ বাগানে পানি সরবরাহে ফিল্টারকৃত পানির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
মাটির কলসে দেশীয় পদ্ধতিতে সহজেই এই ওয়াটার ফিল্টার তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে বড় কলসের নিচের অংশ ফুটো করে কাঠ-কয়লা, বালি, নুড়ি ইত্যাদির স্তর তৈরি করা হয়। কলসের উপরিভাগে পানি ভরে রাখলে তা প্রতিটি স্তরে পরিশোধিত হয়ে নিচে স্থাপিত অপর পাত্রে জমা হয়।
ফিল্টার স্থাপন সম্ভব না হলে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা যেতে পারে। এজন্য বড় ওয়াটার ট্যাংক ও উল্টোনো ছাতির মত কাপড়ের তৈরি রেইন কালেক্টর প্রয়োজন হবে। রেইন কালেক্টরে গড়িয়ে আসা পানি ট্যাংকে জমা হবে। এ পানি আপনার বাগানের বিশুদ্ধ পানির বৃহৎ অংশের যোগান দিতে সক্ষম।
৬. গাছ, মাটি ও সার সাপ্লাই
বাগান তৈরি হওয়ার সাথে সাথে দরকার মাটি, সার ও গাছপালা। গাছ সংগ্রহ হয়ে গেলেও একজন বাগানের মালিক হিসেবে আপনার সার ও মাটির নিয়মিত যোগান প্রয়োজন হবে। নতুন বাচ্চাদের জায়গা দিতে ও প্রিয়জনদের গাছ উপহার দিতে প্রয়োজন হবে টব বা নার্সারি জিও ব্যাগ।
দরকার হবে ফ্রুটব্যাগ, পেস্টিসাইড ও নানান জাতের হরমোন। যা গাছের বর্ধন, রোগ প্রতিরোধ ও ফলের গুনাগুন রক্ষা করে।
এজন্য প্রয়োজন একটি বিশ্বস্ত নার্সারি সাপ্লাই চেইন। তাই বাগান করার পরিকল্পনার পাশাপাশি অনলাইন বা অফলাইন নার্সারির সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ।
৭. কমিউনিটি ভ্রমন, পড়াশোনা ও তথ্য সংগ্রহ
কথায় আছে, “যতনে রতন মিলে”। বিনা যত্নে একটি সফল বাগান তৈরী করা নিতান্তই দুঃসাধ্য ব্যাপার। কাজটি সাধন করতে তাই প্রথমেই আপনার প্রয়োজন বাগান সম্পর্কে সামগ্রিক ধারনা গ্রহণ। এজন্য আপনাকে ভ্রমণ করতে হতে পারে স্থানীয় বাগানীদের বাগান।
কিছু দুর্লভ গাছের তথ্য সংগ্রহ করতে আপনাকে দূর-দূরান্তেও যেতে হতে পারে, করতে হতে পারে বিদেশ যোগাযোগ। এধরনের তথ্য সংগ্রহ আপনার ছাদবাগান তৈরীতে শুধু সাহায্যই করবেনা। বরং বাগানটিকে আপনার পছন্দানুযায়ী সমৃদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া আদিপ্রাণ ফেইসবুক গ্রুপ থেকে গাছের জাত ও যত্ন সম্পর্কে নানান তথ্য জানতে পারবেন। অন্য বাগানীদের সাথে আপনার প্রশ্ন শেয়ার করতে পারবেন। এতে নিজের বাগানের জন্য গাছ নির্বাচন ও পরিচর্যা করা সহজ হবে।
কেনো করবো ছাদবাগান?
সরকারি হিসেব মতে ২০২০ সালে দেশে বনভূমি আচ্ছাদিত এলাকা ১২.৮% মাত্র। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী যা ছিলো মোট ভূমির ১০.৯%। সামাজিক বনায়নকৃত বন ব্যতীত এই হিসেব করা হয়। আর পৃথিবীর মোট বনভূমির পরিমান কমে হয়েছে ৩০.২%।
অথচ ২০২০ সালেই জাতিসংঘের হিসেব মতে পৃথিবীর কার্বন নিঃসরনের পরিমান বেড়ে হয়েছিলো ৩১.৫ গিগা টন, যা এখন আরোও অনেক বেশি। ফলশ্রুতিতে মহাশূন্যের একমাত্র নীল গ্রহে বেড়েছে আকস্মিক বন্যা, খরা, তাপমাত্রা, অতিরিক্ত আদ্রতা ও দূষণ।
একথা মোটামুটি চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায় যে ইট কাঠের এই ঢাকা শহরের ভবিষ্যৎ এখন ছাদবাগানই। চীনের জিয়াংনান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে প্রতি ১ স্কয়ার মিটার (বুদ্ধা ঘাসে ঢাকা) সবুজ ছাদ বাৎসরিক ১.৭ কেজি কার্বন শোষন করে। জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব এর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ছাদ বাগান ঘরের তাপমাত্রা ১.৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। বাগানকৃত ছাদের চেয়ে বাগানবিহীন ছাদ ৭.৮৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হয়। ঢাকা শহরের সকল ছাদ প্রায় ৮০ বর্গ মাইল। সে হিসেবে এই টুকরো টুকরো ছাদ সবুজে ঢাকা গেলে ঢাকার তাপমাত্রা ৫-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানো সম্ভব। সেই সবুজ আগ্রযাত্রার অংশীদার হতে আপনিও একটি ছাদ বাগান করার আগ্রহ প্রকাশ করতেই পারেন।
পরিশেষে বলা বাহুল্য, আধুনিক সময়ে ছাদ বাগান একটি সমৃদ্ধ শখই নয়, বানিজ্যিকভাবেও লাভজনক। ১,৫০০ স্কয়ার ফিটের একটি সবজি বাগান থেকে মাসিক ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। তাই বাগান তৈরির পূর্বে অভিজ্ঞদের পরামর্শ, প্রয়োজনীয় পড়াশোনা করে সময় নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আবশ্যক।
সুন্দর লিখেছো।
ধন্যবাদ,
আপনাদের পজিটিভ মন্তব্য আমাদের ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা ❣️