আমাদের দেশের শীত ইউরোপের শীতের মতো রুক্ষ নয়। তবু শীত আসলেই প্রথম যে কথা মনে আসে তা হলো পাতা ঝরা দিন। চারপাশে কুয়াশার চাদর মোড়ানো পাতা ঝরা দিন । একদম শুষ্ক। কোথাও যেনো কোনো প্রাণ নেই । কিন্তু জানেন কি শীতকালের এই পাতা ঝরা দিনেও আমাদের দেশে অসংখ্য ফুল ফোটে। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বারান্দা, বাগান, অরণ্য। চলুন দেখে নেয়া যাক শীতকালের দশটি প্রিয় ফুল।
গাঁদা
শীতকালের সবচেয়ে পরিচিত ফুল গাঁদা। অনেক গাঁদাফুল ফুটলে মনে হয় যেনো হলুদের সমারেহ। মূলত গাঁদা ফুল আমেরিকা মহাদেশের। তবে আফ্রিকান গাঁদাও হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Tegetes erecta। সারা পৃথিবীতে ৫৬ প্রজাতির গাঁদা পাওয়া গেলেও, বাংলাদেশে মূলত পাঁচ ধরণের গাঁদা পাওয়া যায়। এগুলো হলো-
- রাজগাঁদা
- কালীগাঁদা
- ছোটগাঁদা
- তারাগাঁদা
- মিনুটা গাঁদা
গাঁদা ফুল সাধারণত উজ্জ্বল হলুদ ও কমলা বর্ণের হয়ে থাকে। বিবাহ, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী বা গৃহসজ্জা – কোনোকিছুতেই গাঁদার কোনো বিকল্প নেই। যদিও সারাবছর চাষ হয় এই ফুল, শীতকালের প্রধাণ অলঙ্কার গাঁদা। শাখা কলম ও বীজের মাধ্যমে এর চারা তৈরী করা হয়। দোআঁশ মাটি গাঁদা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
গোলাপ
ফুলের রাণী গোলাপ। ভালোবাসার প্রতীক গোলাপ। সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে পরিচিত ফুল বোধহয় গোলাপ। গোলাপের প্রায় ১৫০ রকমের জাত পাওয়া যায়। যার অনেকগুলি বাংলাদেশে চাষ হয়। জাতভেদে গোলাপের রঙও হয় ভিন্ন ভিন্ন। যেমন : লাল, সাদা, গোলাপী, হলুদ, কালো ইত্যাদি।
বাণিজ্যিকভাবে সারা বছর গোলাপ চাষ হলেও গোলাপ শীতকালের প্রধাণ ফুল। বেশী উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে গোলাপ গাছ ভালো হয়না। সাধারণত ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা গোলাপ গাছের জন্য ভালো। গোলাপ গাছ সাধারণত বীজ, কাটিং, গুটি কলম ও চোখ কলমের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে৷ তবে গোলাপের টব খোলা ও আলো-বাতাসপূ্র্ণ জায়গায় রাখা জরুরি। গোলাপের জন্য অন্তত ৬-৮ ঘন্টা রোদ প্রয়োজন। গোলাপ চাষের জন্য এঁটেল মাটি উপযুক্ত নয়। পানি না জমে এমন উর্বর দোআঁশ মাটিতে গোলাপের চাষ ভালো হয়। সেইসাথে খেয়াল রাখতে হবে যেনো টবের আকার গোলাপের জাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। সাধারণত ছোটো জাতের জন্য ৮ ইঞ্চি ও বড় জাতের জন্য ১২ ইঞ্চি টব ব্যবহার ভালো।
ডালিয়া
ডালিয়া ফুলের আদিনিবাস মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকা। ১৯৬৩ সালে এ ফুলটিকে মেক্সিকোর জাতীয় ফুল ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে আদিনিবাস মেক্সিকো হলেও, বাংলাদেশে এর হরহামেশাই চাষ হয় বাগানে কিংবা ছাদের টবে। এমনকি শীতকালীন ফুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয় বাহারি এই ফুলটি। নানা রঙের হয়ে থাকে ডালিয়া ফুল। যেমন সাদা, কমলা, বেগুনি, হলুদ, গাঢ় গোলাপি ইত্যাদি।
এটি মূলত একটি কন্দযুক্ত, গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। বীজ, মূলজ কন্দ, ডালকলম, এমনকি জোড় কলমের সাহায্যে এর বংশবিস্তার করা যায়। তবে সূর্যালোক খুবই জরুরি। যদি ডালিয়া গাছ পর্যাপ্ত সূর্যালোক না পায়, তবে গাছে ফুল কম ও ছোট হয়। সাধারণত শরৎকালের শেষে ডালিয়ার বীজ বপন বা কলম তৈরী করতে হয়। ৪২ প্রজাতির ডালিয়ার মধ্যে আপনি যেকোন প্রজাতি লাগাতে পারেন। আপনার বাগান বা বারান্দা যেকোন ডালিয়াতেই চমৎকার দেখাবে।
জিনিয়া
ডালিয়ার মতো জিনিয়ারও আদিনিবাস মেক্সিকোতে, তবে সারা পৃথিবীতে এখন এই ফুল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এই ফুল সারাবছর চাষ হলেও, এটি মূলত শীতকালীন ফুল। এর বৈজ্ঞানিক নাম Zinnia elegans। সাধারণত বীজের মাধ্যমে এ ফুল চাষ করা হয়। জুন থেকে অক্টোবর মাসের যেকোন সময় জিনিয়ার চারা উৎপাদনের উপযুক্ত সময়। তবে সূর্যালোক ও উর্বর দোআঁশ মাটি জিনিয়া চাষের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে জিনিয়া ভালো জন্মায় না।
জিনিয়া গাছ সাধারণত ৬০-৭০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। গাছে ডালের সংখ্যা কম হয়। তবে জিনিয়া ফুল নানা রঙের হয়ে থাকে৷ যেমন সাদা, হলুদ, লাল, বাদামী, বেগুনি, কমলা ইত্যাদি। সারা পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ প্রকারের জিনিয়ার জাত পাওয়া গেছে। যার মধ্যে বেশীরভাগই এখন বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
কসমস
মেক্সিকো থেকে আগত আরেকটি শীতকালীন ফুল হলো কসমস। কসমস একটি গ্রীক শব্দ, এর বাংলা অর্থ ঐকতান। এর বৈজ্ঞানিক নাম Cosmos bipinnatus। নানা রঙের হয়ে থাকে কসমস ফুল। যেমন সবচেয়ে পরিচিত কসমসের রঙ উজ্জ্বল কমলা-হলুদ। এছাড়া সাদা, গোলাপি, এমনকি চকলেট রঙেরও কসমস পাওয়া যায়।
সাধারণত বীজের মাধ্যমে কসমসের বংশবিস্তার করা হয়। অক্টোবর নভেম্বর মাস বীজ রোপনের উপযুক্ত সময়। যদিও ছায়াযুক্ত জায়গায় কসমস জন্মে, তবে সূর্যালোকে কসমসের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। কসমস গাছ সাধারণত ২-৪ ফুট লম্বা হয়। তবে কিছু জাত ১ ফুট অব্দিও হয়। এ গাছে বেশী পানির দরকার হয়না। কাজেই আপনি যদি বাগান বা টবে কসমস চাষ করেন, তাহলে সপ্তাহে একদিন পানি দিলেও চলে। তবে মাথায় রাখতে হবে গাছ যেনো হেলে না পড়ে। এ কারণে একটু কম উর্বর মাটিতেই কসমস লাগানো ভালো। এতে গাছও যেমন সুস্থ থাকে, ফুলও সুন্দর হয়, হেলে পড়ার সম্ভাবনাও থাকেনা।
সূর্যমুখী
শীতাকালে যেসব ফুল ফোটে তার মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ও আকারে বড় হলো সূর্যমুখী। সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে বলে এর নাম সূর্যমুখী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বীজ ও তেলের জন্য সূর্যমুখীর বাণিজ্যিক চাষ হলেও আমাদের দেশে সৌন্দর্যের জন্য সূর্যমখী লাগানো হয়। তবে কোথাও কোথাও যেমন রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর প্রভৃতি জায়গায় তেলের জন্য সূর্যমুখীর চাষ হয়।
সাধারণত সূর্যমুখী গাছ ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে৷ আপনি চাইলে বারান্দার টবেও তাই সূর্যমুখী লাগাতে পারবেন। বারান্দায় সূর্যমুখী লাগাতে হলে বড় টবের দরকার হবে। তবে মাটি ভেজা হলে ভালো। সূর্যমুখী গাছের জন্য সূর্যালোক ও পানি দুটিই খুবই দরকার। তাই নিয়ম করে রোজ দুবেলা গাছে পানি দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেনো গাছের গোড়ায় পানি না জমে৷ বীজ থেকেও সূর্যমুখীর চারা তৈরী সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে ভালো বীজ নির্বাচন করা খুব জরুরি।
চন্দ্রমল্লিকা
চন্দ্রমল্লিকা বা চন্দ্রমুখী শীতকালের আরেকটি পরিচিত ফুল। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ক্রিসেনথিমাম। শব্দটি গ্রীক। ক্রিসস অর্থ সোনা, এনথিমাম অর্থ ফুল। আক্ষরিক অর্থে এই ফুলের নাম দাঁড়ায় সোনার ফুল। পূর্ব এশিয়াতে এই ফুলের উৎপত্তি হলেও, বাংলাদেশে এটি একটি জনপ্রিয় ফুল। এ ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম chrysanthemum indicum। বাংলাদেশে চন্দ্রমল্লিকার প্রধাণত তিনটি জাতের চাষ হয়। যথা: তিন রঙা চন্দ্রমল্লিকা, তোরা চন্দ্রমল্লিকা ও মালীর চন্দ্রমল্লিকা। জাতভেদে চন্দ্রমল্লিকার রঙও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন, বাসন্তী, উজ্জ্বল হলুদ, হালকা বেগুনি, হালকা গোলাপি ইত্যাদি।
সাধারণত বীজ বা কাটিংস হতে চন্দ্রমল্লিকার গাছ তৈরী হয়। আপনি যদি কাটিংস বা শাখা থেকে চন্দ্রমল্লিকার গাছ তৈরী করতে চান তবে জুলাইয়ের শেষের দিকে টবে শাখা রোপণ করতে হবে। ১৫-২০ দিন পর একটা বড় টবে লাগাতে হবে। চন্দ্রমল্লিকার জন্য সাধারণত উর্বর হালকা দোআঁশ মাটি বেশী উত্তম। গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেয়া যাবেনা। শীতকালীন অন্যন্য ফুলের মতো চন্দ্রমল্লিকার জন্যও সূর্যালোক আবশ্যক। তাই পর্যাপ্ত রোদ থাকে এমন জায়গায় চন্দ্রমল্লিকা রোপণ করা ভালো।
গাজানিয়া
শীতকালের আরেকটি ফুল যা দেখতে অনেকটি সূর্যমুখীর মতো হলো গাজানিয়া। ইংরেজীতে একে বলে Treasure Flower। এ ফুলটির উৎপত্তি বাংলাদেশের বাইরে হলেও, শীতকালীন ফুল হিসেবে বাংলাদেশে এর কদর বেশ বাড়ছে।
গজানিয়া গাছ ছোট আকারের হয়। উচ্চতা হতে পারে ২০-৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। ফুল সাধারণত উজ্জ্বল হলুদ রঙের হয়। তবে পাঁপড়ির মাঝখানে খয়েরী ডোরাকাটা দাগের জন্য গজানিয়া ফুলকে অন্যন্য উজ্জ্বল হলুদ ফুলের চেয়ে আকর্ষণীয় লাগে।এছাড়াও গজানিয়ার কিছু জাতে অন্য রঙেরও ফুল ফোটে। যেমন: ঘিয়া, লাল, সাদা ও বাদামী। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আগত এই ফুলটি সাধারণত সকালে ফোটে, বিকালে ঝরে যায়। বীজ থেকেই এই গাছের চারা তৈরী করা যায়, তবে কাটিং বা শাখা থেকে চারা তৈরী করাই বেশী ভালো। তবে মনে রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যেনো পানি না জমে। সেই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে গাজানিয়া যেনো পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পায়। গাজানিয়া চাষের জন্য উর্বর দোআঁশ মাটিই উত্তম। টবে লাগাতে চাইলে মাটির সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার মিশাতে হয়।
ডেইজি
ডেইজি আকারে ছোট ফুল, অনেকটা ছোট সূর্যমুখীর মতো। তবে সূর্যমুখীর মতো এই উজ্জ্বল হলুদ রঙের ফুল সূর্যের দিকে মুখ করে থাকেনা। বরং এর ফুল উর্ধ্বমুখী। ডেইজির বৈজ্ঞানিক নাম Chrysanthemum carinatum। এই ফুলটি বিদেশি হলেও বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এটি চমৎকার মানিয়ে গেছে। এ কারণেই ডেইজি চোখেও পড়ে সহজে।
ডেইজি গাছ সাধারণত এক থেকে দেড় ফুট উঁচু হয়ে থাকে। ফুল কান্ডের মাথায় ফোটে। এ গাছটা কিছুটা গুল্ম প্রকৃতির। খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। সাধারণত শীতকালেই এই ফুল ফোটে, বসন্তকালের মাঝামাঝি সময়ে ফুল ফোটা বন্ধ হয়ে যায়। বীজের মাধ্যমে ডেইজির বংশবিস্তার করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে ডেইজির জন্য উর্বর বেলে দোঁআশ মাটি উত্তম। সেই সাথে পর্যাপ্ত সূর্যালোকও। সাধারণত অক্টোবর নভেম্বর মাস ডেইজি রোপণের জন্য উপযুক্ত সময়।
ডায়ান্থাস
শীতকালের আরেকটি অসাধারণ ফুল ডায়ান্থাস। ডায়ান্থাস গ্রীক শব্দ। এর অর্থ ঈশ্বরের ফুল। প্রাচীন গ্রীসে এই ফুল পূজা- আরাধনায় ব্যবহার করা হতো। ডায়ান্থাস আকারে ছোট ফুল। তবে এর অনেক রকমের জাত আছে। সারা পৃথিবীতে ডায়ান্থাসের প্রায় ৩০০ জাত পাওয়া যায়। প্রতিটি জাতই একটি আরেকটির চেয়ে আলাদা। তাই ডায়ান্থাসকে কেউ কেউ সুইট উইলিয়াম বা বেবী ডল নামেও চেনে।
ডায়ান্থাসের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর এত পরিচর্যার দরকার পড়েনা। এমনকি সারাদিন সূর্যের আলোরও দরকার পড়েনা। মাত্র তিন-চার ঘন্টা রোদ পড়লেই দারুণ ফুল ফোটে। তবে ডায়ান্থাসের জন্য ভালো মাটি নির্বাচন জরুরি। সাধারণত উর্বর বেলে দোআঁশ মাটিতে ডায়ান্থাস ভালো জন্মে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে টবে পর্যাপ্ত পরিমাণ কম্পোস্ট সার রয়েছে। সাধারণত শীতের শুরুতেই ডায়ান্থাস ফোটা শুরু করে। এ কারণে নভেম্বরের শুরুতে গাছে পিঞ্চিং করে দেওয়া উত্তম। এতে গাছ ফুল ফোটে বেশী।